ইসলামী সংগঠনে পরামর্শ
পরামর্শ শব্দের শাব্দিক অর্থ হল মতামত দেওয়া,মত বিনিময় করা।একে আরবীতে বলে ‘শুরা’ আর ইংরেজীতে বলে Counsel, Advice . কোন কাজ সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহনের পূর্বে সহযোগীদের সাথে যোগাযোগ ও উদার মন নিয়ে যে মতবিনিময় করা হয় বা যে মতামত পেশ করা হয় তাকে পরামর্শ বলে।পরামর্শ নেয়া ও পরামর্শ দেয়া ইসলামী সংগঠনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
পরামর্শের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
১. পরামর্শ দেওয়া নেওয়া আল্লাহর নির্দেশ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সামষ্টিক কাজ কর্মে আসহাবে কিরামের সাথে পরামর্শ করার জন্য রাসূল (সা)কে নির্দেশ দিয়েছেন।আল্লাহ বলেন-“কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর।কোন বিষয়ে তোমার মত সুদৃঢ় হয়ে গেলে আল্লাহর ওপর ভরসা কর।নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাক ভরসাকারী লোকদেরকে ভালোবাসেন।”– আলে ইমরান:১৫৯
২. পরামর্শ করা রাসূল(সা)এর সুন্নাত
রাসূল (সা) নিজে আল্লাহর নির্দেশের আলোকে সাহাবায়ে কেরামের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা)রাতে মুসলিমদের সামষ্টিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আবু বকরের সাথে পরামর্শ করতেন।আমিও তাদের সাথে থাকতাম।(জামে আত-তিরমিযী)
৩. পরামর্শ করা সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য
গোটা সাহাবায়ে কেরামের(রা)জামায়াত পারস্পরিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।আল্লাহ বলেন-“তাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়”।-আশ-শূরাঃ৩৮
৪. পরামর্শ হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের নিরাপত্তা প্রহরী
ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের অভ্যন্তরে যাবতীয় সমস্যা থেকে সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরকে হেফাযত করে কাঙ্খিত মঞ্জিলে পৌঁছাতে নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে এই পরামর্শ।রাসূল (সা)বলেছেন-যে ইস্তেখারা করবে, সে কোন কাজে ব্যর্থ হবেনা।যে পরামর্শ করবে সে লজ্জিত হবেনা।যে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে,সে দারিদ্রে নিপতিত হবেনা।(আল-মু’জামুস সগীর)
৫. পরামর্শের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তে আল্লাহ পাকের রহমত থাকে
খন্দকের যুদ্ধে রাসূল (সা)হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)এর পরামর্শে পরিখা খনন করে যুদ্ধ পরিচালনা করলেন।আল্লাহ পাক এতে তার সাহায্য ও রহমতের হস্ত প্রসারিত করে দিলেন এবং কাফেরদের সকল চক্রান্ত নস্যাত করে দিলেন।
৬. সংগঠনের মধ্যে চিন্তার ঐক্য সাধনের জন্য
সংগঠনের সর্বপর্যায়ে চিন্তার ঐক্য সাধন করতে হলে বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের মাঝে বেশী পরিমান পরামর্শ নেওয়া-দেওয়া জরুরী।দায়িত্বশীলদের মাঝে মনখোলা পরামর্শের পরিবেশ না থাকলে এটা সংগঠনের অভ্যন্তরে সংহতিকে বিনষ্ট করে দেয়।দায়িত্বশীলগণের চিন্তার বিনিময় না হলে, ভাবের আদান-প্রদান না হলে চিন্তার ঐক্য গড়ে উঠতে পারে না।অথচ চিন্তার ঐক্য ছাড়া ইসলামী সংগঠনের কোন সার্থকতাই থাকতে পারে না।
দায়িত্বশীলদের সাথে পরামর্শের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসূল (সা)বলেছেন -আল্লাহ যখন কোন আমীরের ভাল চান তাহলে তাঁর সত্যবাদী উজির নির্বাচিত করেন, আমীর কিছু ভুলে গেলে তিনি তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেন, আমীর কোন কাজ করতে চাইলে সে কাজে তাকে সহযোগিতা করেন। আল্লাহ যদি আমীরের অমঙ্গল চান তাহলে তার জন্যে মিথ্যাবাদী উজির নিয়োগ করেন, তিনি কোন কাজ ভালভাবে তাকে স্মরণ করিয়ে দেন না, আমীর কোন কাজ করতে ইচ্ছে করলে তিনি সে কাজে তার সহযোগী হননা। (আবু দাউদ)
৭.পারস্পরিক পরামর্শ দুনিয়ার জিন্দেগীর কল্যাণ ও সৌভাগ্যের উৎস
রাসূল(সা)বলেছেন, যখন তোমাদের নেতারা হবেন ভাল মানুষ, ধনীরা হবেন দানশীল এবং তোমাদের কার্যক্রম চলবে পরামর্শের ভিত্তিতে তখন মাটির উপরের ভাগ নিচের ভাগ থেকে উত্তম হবে।আর যখন তোমাদের নেতারা হবে খারাপ লোক, ধনীরা হবে কৃপণ এবং নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব যাবে নারীদের হাতে তখন পৃথিবীর উপরের অংশের চেয়ে নীচের অংশ হবে উত্তম(তিরমিযী)।
৮. পরামর্শ স্বৈরাচারী হবার পথ রুদ্ধ করে দেয়
৯. পরামর্শের ভিত্তিতে উত্তম সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়
সংগঠন পরিচালনায় পরামর্শ গ্রহনের উপকারিতা
১. সাথী-সহকর্মী মূলত যারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠে ময়দানে দায়িত্ব পালন করে থাকে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ দেয়ার সুযোগ দিলে বা তাদের সাথে পরামর্শ করলে আনুগত্যের স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
২. জনশক্তির মাঝে দায়িত্বানুভূতি বৃদ্ধি পায়।পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে সবাই একে নিজের সিদ্ধান্ত মনে করে অত্যদিক পেরেশানী নিয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ময়দানে ভূমিকা রাখে।।
৩. জনশক্তিদের মাঝে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা ও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়
৪. সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোন প্রকার অসুবিধা দেখা দিলে বিরূপ সমালোচনা ও অবাঞ্ছিত মন্তব্যের ক্ষতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার কোনই সুযোগ থাকে না।
৫. পরামর্শ সকল প্রকার সন্দেহ সংশয় দূর করে সংগঠনের অভ্যন্তরে জান্নাতী পরিবেশ তৈরি করে।
৬. পরামর্শে অংশগ্রহণের ফলে সকলের মাঝে কাজের গুরুত্বের উপলব্ধি স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়।
৭. কাজের গুরুত্ব ও প্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা জন্মে
৮. সামষ্টিক সিদ্ধান্ত ভুল হলেও কোন একক ব্যক্তির উপর দোষ বর্তায়না।
৯. যে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে সে নিরাপদ থাকে
১০. পরামর্শকেন্দ্রিক কাজে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত-বরকত যোগ হতে থাকে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়,বদরের যুদ্ধের ব্যাপারে রাসূল (সা) আনসারদের সাথে যখন পরামর্শ করলেন তখন তাদের উৎসাহের সীমা থাকল না। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘোষনা করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি যদি বলেন সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে, আমরা বিনা দ্বিধায় তাতেও প্রস্তুত আছি। আমরা কওমে মূসার মত উক্তি করব না।
পরামর্শ দেওয়ায় নিয়ম
পরামর্শ দেয়া কেবল গঠনতান্ত্রিক অধিকারই নয় বরং ইসলামী সমাজে ও সংগঠনে এটা একটা পবিত্র আমানত।আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্যে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে খোদার দেওয়া বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব কর্মকৌশল উদ্ভাবন ও পরিকল্পনা প্রণয়নে সহযোগিতা দান করা সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেকের দ্বীনি দায়িত্ব।কোন সময়ে কোন দিক থেকে ক্ষতির আশঙ্কা মনে হলে, সেই ক্ষতি থেকে সংগঠনকে রক্ষা করার জন্যে এই সম্পর্কে দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি আকর্ষন করা একটা পবিত্র আমানত।ক্ষতির আশঙ্কা মনে জাগল অথচ দায়িত্বশীলকে জানালাম না, কল্যান চিন্তা মগজে এলো কিন্তু দায়িত্বশীলকে জানানো হলো না তাহলে আল্লাহর দরবারে খেয়ানতকারী হিসেবে জবাবদিহি করতে হবে।
পরামর্শের এই দ্বীনি ও ঈমানী মর্যাদাকে সামনে রেখে আন্দোলন ও সংগঠনের সার্বিক কল্যাণ বিবেচনায় এনে সংগঠনকে পরামর্শ দিতে হবে।তবে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম পদ্ধতির অনুসরণ না করলে পরামর্শের কল্যাণকামিতার চাইতে ক্ষতির দিকটাই মারাত্মক হতে পারে।কাজেই আমাদেরকে পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে যতটা সচেতন হতে হবে, ততটা সচেতন হতে হবে পরামর্শ দেওয়ার নিয়মনীতি মেনে চলার ব্যাপারেও।পরামর্শ প্রদানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নিয়মনীতি সমুহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. কল্যাণ কামনার উদ্দেশ্য উন্মুক্ত মনে পরামর্শ দেওয়া
২. নিজের মনের চিন্তা ও পরামর্শ প্রথমতঃ নিকটস্থ দায়িত্বশীলদের কাছে ব্যক্ত করা এবং প্রয়োজনে উদ্ধতন দায়িত্বশীলদের কাছে লিখিতভাবে পরামর্শ পেশ করা।
৩. স্বতঃস্ফুর্তভাবে এবং নিজ দায়িত্বে পরামর্শ দেওয়া
৪. চিন্তা-ভাবনা করে আন্তরিকতার সাথে মত প্রকাশ করা
৫. সিদ্ধান্ত গ্রহনের পূর্বে পরামর্শ দেওয়া
৬. মার্জিত ভাষায় পরামর্শ দেওয়া
৭. পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে গ্রুপিং না করা
৮. দ্বিধিহীন চিত্তে স্পষ্টভাবে মতপ্রকাশ করা
৯. পরামর্শ গৃহীত হবে কিনা তা বিবেচনায় এনে পরামর্শ দেওয়া যাবেনা
১০. পরামর্শ গৃহীত না হলে সন্তুষ্টি সহকারে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ও নিজের মত ভুলে যাওয়া
১১. নিজের মতের বিপরীত সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে তা বাইরে প্রকাশ না করা।আমার মতামতটাই সঠিক ছিল- এ জাতীয় মনোভাব পোষণ করা কিছুতেই ঠিক নয়।ওহীর জ্ঞান ছাড়া আর কোন জ্ঞান নির্ভুল হতে পারেনা।সামষ্টিকভাবে যদি ভুল মতামতের উপর সিদ্ধান্ত কখনো হয়ে যায়,তাহলে সেই বিষয়ে আল্লাহ নারাজ হবেননা।
উদাহরুন স্বরূপ বলা যায়-বদর যুদ্ধের সময় যুদ্ধ বন্দিদের ব্যাপারে রাসূল(সা)পরামর্শ চাইলেন।এতে উমর (রা)পরামর্শ দিলেন-বন্দিদের স্ব-স্ব আত্মীয়-স্বজনরা তাদেরকে হত্যা করবে।আবুবকর (রা) মুক্তিপন নিয়ে মুক্ত করার পক্ষে মতামত দিলেন।রাসূল (সা)আবু বকর (রা) এর মতামত গ্রহন করলেন।অন্যদিকে আল্লাহ পাক অহী নাযিলের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন হযরত ওমরের মতামতটাই সঠিক ছিল।কিন্তু পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া বিষয়ে আল্লাহ পাক নারাজির কথা উল্লেখ করেননি।
১২. সামষ্টিক মতের নিকট নিজের মতের কুরবানী দেওয়া।পরামর্শদাতার মন এতটা উন্মুক্ত থাকতে হবে যে, তার পরামর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্তও যদি হয় তাহলে সে দ্বিধাহীনচিত্তে তা মেনে নেবে। তার মনের সপক্ষে এবং বিপক্ষে সে কোন মন্তব্যও করবেনা।
মনে রাখতে হবে, মানুষের পক্ষে মতামত কোরবানী দেয়াটাই বড় কোরবানী।মানুষ অনেক ত্যাগ-কোরবানীর নজীর সৃষ্টি করার পরও মত কোরবানীর পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে যায়। অথচ জামায়াতী জিন্দেগীর জন্যে এই কোরবানীই সবচেয়ে জরুরী। জামায়াতী ফায়সালার কাছে যে ব্যক্তিগত রায় বা মত কোরবানী করতে ব্যর্থ হয় সে প্রকৃতপক্ষে জামায়াতী জীবনযাপনেই ব্যর্থ হয়। পরিণামে এক সময় ছিটকে পড়ার আশঙ্কা থাকে।আন্দোলন ও সংগঠনের অনেক দূর অগ্রসর হওয়ার পরও যারা ছিটকে পড়ে তারা মূলত এই ব্যার্থতার কারণেই ছিটকে পড়ে।তাই চিন্তা ভাবনা ও পরামর্শ উদ্ভাবনের মুহূর্তে সবাইকে জামায়াতী জিন্দেগীর এই চাহিদা এবং বাস্তবতাকে অবশ্যই সামনে রাখতে হবে।হাজার মতের, একশ’ মতের ভিত্তিতে কোনদিন আন্দোলন সংঠন চলতে পারে না, সংগঠনকে একটা মতের উপর এসেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।কাজেই শত শত হাজার হাজার কর্মী যার যার মতের উপর জিদ করলে বাস্তবে কি দশাটা দাঁড়ায় তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন করে না।
পরামর্শ ক্ষেত্রে কতিপয় বাস্তব সমস্যা
বারবার বলা যা একদেশদর্শিতার পর্যায়ে পড়ে
সিদ্ধান্তের মত করে পরামর্শ দেওয়া
পরামর্শের বিষয়ে বাহিরে আলোচনা
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোন ত্রুটি দেখা দিলে নিজের পরামর্শের সাফাই গাওয়া
পরামর্শের ব্যাপারে সর্বশেষ কথা হল-যদি আপনার পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়,তাহলে আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করুন।কারণ এ পরামর্শের মধ্যে যদি কোন ক্ষতিকর কিছু থাকে ,তাহলে আল্লাহ পাক যেন সংগঠনকে এই ক্ষতিকর প্রভাব থেকে হেফাজত করেন।
ইসলামী সংগঠনে ইহতিসাব
এই যুগে কোন নবী নেই। নবীর গড়া কোন মানুষও নেই।আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদেরকেই আজ ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালাতে হচ্ছে ঈমানের দাবী পূরণের জন্য।কিন্তু আমাদের জীবনে আছে বহু ভুলভ্রান্তি।কোন মুমিন সারা জীবন ভুল-ভ্রান্তি আবর্জনায় গড়াগড়ি দিতে থাকুক, এটা আল্লাহ চান না।তাই তিনি মুমিনদেরকে তাদের চিন্ত-ভাবনা, কথাবার্তা, লেন-দেন ও যাবতীয় কাজ কর্মের পরিশুদ্ধির কাজে মনোযোগী হতে উৎসাহিত করেছেন।
আর মুমিনগণ যাতে একে অপরের ভুলভ্রান্তি দেখিয়ে দেয় তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাসূল(সা) বলেছেন, “মুমিন মুমিনের আয়না।”-সুনানু আবী দাউদ
আয়না যেভাবে একজন ব্যক্তিকে তার সাজগোছে কোথায় কোন ত্রুটি আছে তা দেখিয়ে দেয়, একজন মুমিনও সেভাবে আরেকজন মুমিনের জীবনে কোথায় কী ত্রুটি আছে তা দেখিয়ে দেবে।সাধারণত: অবচেতনভাবেই মানুষ ভুল করে।কেউ যদি এই ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তবেই সে সচেতন হয়ে তার জীবন থেকে ভুল-ভ্রান্তি দূর করার পদক্ষেপ নিতে পারে। একে অপরের ভুল ভ্রান্তি দেখিয়ে দেয়ার এই প্রক্রিয়ারই নাম ইহতিসাব।
ইহতিসাব শব্দটি আরবী।এর বাংলা অর্থ হল-গঠনমূলক সমালোচনা বা সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনা।অপরের কল্যান কামনায় ভুল ত্রুটি দেখিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিকে ইহতিসাব বলে।
ইহতিসাবের গুরুত্ব
১. সংগঠনকে গতিশীল করার জন্য
সাংগঠনিক সুস্থতা,সংশোধন ও গতিশীলতার জন্য গঠনমূলক সমালোচনার দ্বার উন্মুক্ত থাকা জরুরী।গঠনমূলক সমালোচনা করার সুন্দর পরিবেশ জারি থাকলেই দোষ-ত্রুটি যথাসময়ে প্রকাশিত হয় এবং তা সংশোধনের প্রচেষ্টাও চালানো যায়।মনে রাখতে হবে,সংগতঠনের সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত দেহের জন্য সমালোচনার চাইতে উত্তম পন্থা আর কিছু নেই।
সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ)বলেন,সমালোচনামূলক চিন্তাকে দাবিয়ে দেওয়ার চাইতে দলের বড় অকল্যাণ আর কিছুই হতে পারেনা।
২. গীবতের পথ বন্ধ করার জন্য
গীবত হল এক মারাত্মক রোগের নাম।এই রোগের প্রতিষেধকের জন্য সমালোচনা চালু থাকা জরুরী। এটি একটি ফেতনা বিশেষ।কারণ মানুষ তার ভাইয়ের সামনে নয়;বরং পিছনে বসে নিন্দাবাদ করে।কুরআন গীবত করাকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাবার সঙ্গে তুলনা করেছে।আল্লাহ বলেন-তোমাদের কেউ যেন অপর কারো গীবত না করে।তোমরা কি কেউ আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে?এটাকে তো তোমরা অবশ্যই ঘৃণা করবে।-হুজরাতঃ১২
কারো গীবত করা যেমন হারাম,তেমনি অন্য কোন ভাই কারো ব্যাপারে গীবত করলে তা শোনাও ইসলামী শরীয়তে জায়েজ নেই।ইচ্ছাকৃতভাবে গীবত শোনাও নিজে গীবত করার শামিল।
হযরত মায়মুনা (রা) বলেন-একদিন আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম,জনৈক সঙ্গী ব্যক্তির মৃতদেহ পড়ে আছে এবং এক ব্যক্তি আমাকে বলেছে একে ভক্ষন কর।আমি বললাম, আমি কেন একে ভক্ষন করব? সে বলল,কারণ তুমি অমুক ব্যক্তির সাথী গোলামের গীবত করেছ।আমি বললাম,আল্লাহর কসম!আমি তার সম্পর্কে ভাল-মন্দ কিছুই বলিনি।সে বলল,হ্যাঁ,এ কথা ঠিক;কিন্তু তুমি তার গীবত শুনেছ এবং এতে সায় দিয়েছ।এ ঘটনার পর হযরত মায়মুন(রা)নিজে কখনো কারো গীবত করেননি এবং তা মজলিসে কাউকে গীবত করতেও দেননি।(তাফসীরে মাআরেফুল কুরয়ানঃ১২৮৪ পৃষ্ঠা)
৩. সন্দেহ প্রবণতা দূর করার জন্য।
সন্দেহ প্রবণতা,নিকৃষ্ট অনুমান,কুধারণা এক গুরুতর ব্যাধি।এ ব্যাধি পারস্পরিক সম্পর্কে ঘুণ ধরিয়ে দেয় এবং তাকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলে।আমাদের কারো মধ্যে কোন ভাইয়ের ব্যাপারে বা দায়িত্বশীলদের ব্যাপারে কোন ধারণার জন্ম নিলে তা যথাসাধ্য পরিহার করার চেষ্টা করবেন।যদি এড়াবার চেষ্টা সত্ত্বেও সন্দেহের সৃষ্টি হয়,তাহলে তা মনের মধ্যে চেপে না রেখে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট ভাইয়ের নিকট গিয়ে সংযতভাবে প্রকাশ করবেন,যাতে করে সে নিরসন করতে পারে।মনে রাখতে হবে,মনের মধ্যে সন্দেহ চেপে রাখা খেয়ানতের শামিল।
আল্লাহ বলেন-হে ঈমানদারগন!অনেক বেশি ধারণা করা থেকে দূরে থাকো।কারণ কোন কোন ধারণা বা অনুমান হচ্ছে গুনাহ,আর গোয়েন্দাগিরি করোনা। -হুজরাতঃ১২
রাসূল (সা) বলেছেন, সাবধান!তোমরা অনুমান পরিহার কর,কেননা আনুমান হচ্ছে নিকৃষ্ট মিথ্যা কথা(বুখারী,মুসলীম)
আমরা যেমন অন্যের ব্যাপারে যাবতীয় আন্দাজ-অনুমান থেঁকে বেঁচে থাকবো,ঠিক তেমনিভাবে আমাদেরকেও নিজের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণের বিষয়ে অন্য ভাইদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।এ সম্পর্কে স্বয়ং রাসূল (সা)আমাদের সামনে উদাহরণ পেশ করেছেন।একবার রাসূল (সা) ইতিকাফে বসেছিলেন।রাতে তার জনৈক স্ত্রী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন।যাবার পথে তিনি তাকে এগিয়ে দিতে চললেন।ঘটনাক্রমে ২ জন আনসারের সঙ্গে দেখা হল।তারা রাসুল (সা)কে স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখে নিজেদের আগমনকে বেমওকা মনে করে ফিরে চললেন।অমনি তিনি তাদেরকে ডেকে বললেন,শুন!এ হচ্ছে আমার অমুক স্ত্রী।আনসারদ্বয় বললেন,ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)কারো প্রতি যদি আমাদের সন্দেহ পোষণ করতেই হতো তবে কি আপনার প্রতি করতাম?তিনি বললেন “শয়তান মানুষের ভেতর রক্তের ন্যায় ছুটে থাকে”।
ইহতিসাবের উদ্দেশ্য
১. অপরের দোষ-ত্রুটি সংশোধনের জন্য
২. অপর ভাইয়ের কল্যান কামনার উদ্দেশ্য সামনে রেখে গঠনমূলক সমালোচনা।
৩. সম্পর্ক উন্নয়ন ও গভীর করার জন্য।
আল্লাহ বলেন,নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।অতএব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের সকলের মধ্যে পারস্পরিক কল্যাণকর ব্যবস্থা প্রদান কর।-সূরা হুজরাতঃ১০
রাসূল (সা) বলেছেন,তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা,যতক্ষ্ণ পর্যন্ত মুমিন না হবে।আর ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত একে অপরকে ভালোবাসবে না ।(মুসলিম)
৪. ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য
ইহতিসাবের পদ্ধতি
১. ব্যক্তিগতভাবে একে অপরকে সংশোধনের চেষ্টা করা
২. ব্যক্তগত পর্যায়ে সংশোধন না হলে দায়িত্বশীলকে জানানো
৩. তাতেও সংশোধন না হলে দায়িত্বশীলের অনুমতি সাপেক্ষে সামষ্টিক প্রোগ্রামে ইহতিসাব করা।
ব্যক্তিগত ইহতিসাবঃ
– ব্যক্তির কল্যান কামনায় সংশোধনের নিমিত্তে ইহতেসাব করা
– ব্যক্তিতে একান্তভাবে বলা
– ব্যক্তিকে একান্তভাবে বলার পর যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দিলে তা মেনে নেওয়া
সামষ্টিক ইহতিসাবঃ
– ব্যক্তিগত মুহাসাবার মাধ্যমে সংশোধিত না হলে সংশ্লিষ্ট ফোরাম বা বৈঠকে ব্যক্তির মুহাসাবা করা।
– বৈঠকে বা ফোরামে যে রায় হবে তা মেনে নেওয়া
যিনি ইহতিসাব করবেন তার করনীয়
১. সকল স্থানে ও সকল সময়ে ইহতিসাব করা যাবেনা।মন-মানসিকতা,সময় ও পরিবেশ বুঝে ইহতিসাব করতে হবে।কঠিন সমস্যা-পীড়িত মানুষ কোন প্রকারের সমালোচনা বরদাশত করতে পারে না অথবা যথার্ত মিজাজে সমালোচনা গ্রহণ করতে পারে না। সেই জন্য ইহতিসাব করার পূর্বে ব্যক্তির মানসিক অবস্থা যাচাই করে নিতে হবে।
২. ইহতিসাবের ভাষা হবে মোলায়েম,ভাষায় কোন তেজ থাকবেনা এবং ক্ষোভের অভিব্যক্তিও ঘটবে না বরং অত্যন্ত দরদ ভরা হবে।
৩. ইহতিসাব যিনি করবেন তার চেহারা ও ভাব-সাবে রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ পাবে না।
৪. সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেন বুঝতে সক্ষম হয় যে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা নয় বরং তার ত্রুটি দেখিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই তাকে ইহতিসাব করা হচ্ছে।
৫. কারণ দর্শানোর পর ঐকান্তিকতার সাথে মেনে নেওয়া এবং সবকিছু অন্তর থেকে মুছে ফেলা
৬. মেজাজ ঠিক না থাকলে ইহতিসাব না করা
৭. আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে ইহতিসাব করা
৮. সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ত্রুটি সমূহ দূর হবার জন্য আল্লাহর নিকট দোআ করা
যার ইহতিসাব করা হবে তার করনীয়
ইহতিসাব মাথা পেতে নেয়া নিশ্চয়ই বাহাদুরি কাজ।কোন কাপুরুষের পক্ষে ইহতিসাবের মুকাবিলায় মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভবপর নয়।কিন্তু ইসলামী সংগঠনের কর্মীগণ এই ধরনের কাপুরুষতার শিকারে পরিণত হবেন, এটা কাম্য নয়।তাই ইসলামী সংগঠনের প্রতিটি কর্মীকে ইহতিসাবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।ইহতিসাবের কল্যাণকারিতা থেকে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করতে হবে এবং সত্যকে অকাতরে মেনে নেয়ার মনোবৃত্তি রাখতে হবে।ইহাতিসাবের কল্যাণকারিতা সম্পর্কে যেই ব্যক্তি সচেতন সেই ব্যক্তিই ইহতিসাবকে খোশ আমদেদ জানাতে পারে। এমন ব্যক্তির কাছে থেকে ইহতিসাবের যে জবাব আসবে তা সংগঠনের সুস্থতা অক্ষুন্ন রাখবে এবং সংগঠনের কর্মীগণ আয়নার ভূমিকা পালন করার হিম্মত রাখতে পারবে।এছাড়াও যাকে ইহতিসাব করে হবে তিনি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে সামনে রেখে ইহতিসাবের জবাব দিবেন।
১. ছল-চাতুরীর আশ্রয় না নিয়ে ত্রুটির স্বীকৃতি দেওয়া
২. সুন্দর ভাষায় কারণ বর্ণনা করা
৩. সংশোধনের জন্য দোয়া কামনা করা ও প্রচেষ্টা চালানো
৪. ভুল ধারণা অন্তর থেকে মুছে ফেলা
সংগঠনে ইহতিসাব না থাকার পরিনাম
১. আন্দোলনের গতিশীলতা থাকেনা
২. পারস্পরিক সম্পর্কে কৃত্রিমতা আসে
-খারাপ ধারণা রেখে কারো সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক রাখা যায়না
-এ জাতীয় সম্পর্ক হয় মেক-আপ লাগানো
-এর দ্বারা ঈমানের দাবী পূরন হয়না
৩. পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস কমে আসে
৪. গীবতের মত মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়বে
মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের প্রাণশক্তি হিসেবে পরিচিত পরামর্শ ও ইহতিসাবের উপর সম্যক ধারণা অর্জন করে ইসলামী সংগঠনের গতিসঞ্চারে সঠিকভাবে ভূমিকা পালনের তাওফিক দিন। আমীন