আমরা যা বিশ্বাস করি তার বাস্তব প্রয়োগ হল ব্যবহারিক জীবন। জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও আকিদার উপর ব্যবহারিক জীবনের মান নির্ভর করে। ঈমান হল বিশ্বাস আর ইসলাম হল বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করা। আদর্শিক আন্দোলনের কর্মীদের বাস্তব জীবন তার ঈমানের উপর প্রতিপালিত হতে হবে। যাদের কাজ তার ঈমানের বিপরীত সেই হল মুনাফিক। আকিদাগত মুনাফিক ছিল আব্দুল্লাহ বিন উবাই। এ ধরনের মুনাফিকের সংখ্যা আমাদের সমাজে বেশি।
ব্যবহারিক জীবনের গুরুত্ব:
আদর্শিক আন্দোলনের কর্মীদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে সফলতার জন্য ইসলামের আলোকে ব্যবহারিক জীবন পরিচালনা করা জরুরি।
আদর্শিক আন্দোলনের দাওয়াতের মাধ্যম প্রধানত ২টি। যথা:
১.মৌখিক সাক্ষ্যদান
২.ব্যবহারিক জীবন
আল্লাহর রসুল (সা.) এর নবুয়ত লাভের পর যে লোকগুলোর নিকট তাঁর জীবনের কোন একটি দিকও গোপন ছিল না, তাঁরাই সর্বপ্রথম তাঁর নবুয়তের স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। নিম্মে কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করা হল:
হযরত খাদিজা (রা.)
যিনি বিগত ১৫ বছর নবুয়ত লাভের পূর্বে রসুল (সা.) এর জীবন সঙ্গী ছিলেন। নবুয়তকালে তার বয়স ছিল ৫৫ বছর। যিনি ১৫ বছর আড়াল বিহীন নিকট থেকে রসুল (সা.) কে দেখেছেন। এরকম একজন বয়স্কা, অভিজ্ঞ মহিলা কোন পার্থিব উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য স্বামীর নাজায়েজ কাজে শরীক হতে পারে বটে কিন্তু কোন অবস্থাতেই তার অপকর্মের প্রতি ঈমান আনতে পারে না। রসুল (সা.) যখন তাঁর নিকট নবুয়ত লাভের ঘটনা বর্ণনা করেন, তখন একটি মুহূর্ত পর্যন্ত চিন্তা না করে দ্বিধাহীন চিত্তে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি ঈমান আনেন।
হযরত যায়েদ (রা.)
একেবারে নিকট থেকে রসুল (সা.) কে যারা জানতেন, তাঁদের দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন হযরত যায়েদ বিন হারেছা (রা.)। তিনি একজন গোলাম হিসেবে ১৫ বছর বয়সে রসুল (সা.) এর ঘরে আসেন। নবুয়তের সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছর। ছোট বেলায় পিতা মাতা থেকে নিখোঁজ হন। পিতা-চাচারা যখন জানতে পারলো তাঁদের সন্তান অমুক স্থানে গোলামির জীবন-যাপন করছে, তখন তাঁরা যায়েদ (রা.) কে ফিরিয়ে নিতে মক্কায় এলো। এটা হচ্ছে রসুল (সা.) এর নবুয়ত লাভের আগের ঘটনা। তাঁরা এসে বলল, আমাদের ছেলেটাকে যদি আযাদ করে দেন, এটা আমাদের প্রতি বড়ই মেহেরবানী হবে।
তাঁরা পিতা-চাচা তাকে নেওয়ার কথা বললে, যায়েদ বিন হারেছা বললেন, “আমি এ ব্যক্তির মধ্যে এমন সব সুন্দর গুণাবলী দেখেছি, যা দেখার পর আমি তাঁকে ছেড়ে পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের নিকট ফিরে যেতে চাই না।” এ ছিল মনিব সম্পর্কে খাদেমের সাক্ষ্য।
হযরত আবুবকর (রা.)
আবুবকর (রা.) নবুয়তের ২০ বছর পূর্ব থেকে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে রসুল (সা.) কে দেখার এবং জানার সুযোগ পেয়েছেন। হযরত আবু বকর (রা.) কর্তৃক নির্দ্বিধায় তাঁর নবুয়তের স্বীকৃতি দান এ কথার প্রমাণ করে যে, ২০ বছরের সুদীর্ঘ সময়ে তিনি রসুল (সা.) কে পবিত্র, সুউচ্চ স্বভাব ও আচরণের প্রতিচ্ছবি হিসেবে পেয়েছেন।
হযরত আলী (রা.)
ইসলাম গ্রহণের সময় যাঁর বয়স ছিল ১০ বছর। রসুল (সা.) এর ঘরেই প্রতিপালিত হয়েছেন। ১০ বছরের বালকও যে ঘরে থাকে যাঁর কাছে থাকে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সেও ওয়াকিবহাল থাকে।
রসুল (সা.) এর নিকটতম দুশমন আবু জেহেলও একবার বলেছিলেন, হে মুহাম্মদ (সা.)! আমরা তো তোমাকে মিথ্যা চলছি না। আমরা তো ঐ দাওয়াতকে মিথ্যা বলছি যা তুমি নিয়ে এসেছো। অর্থাৎ নিকৃষ্টতম দুশমনও তাঁর সত্যবাদিতার প্রবক্তা ছিল।
আদর্শিক আন্দোলনের একজন কর্মীকে এমন হতে হবে যাতে তাঁর জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতিচ্ছবি ফুঁটে উঠে। মানুষকে উন্নত চরিত্র শিক্ষা দেয়ার জন্য রসুল (সা.) এর আগমন ঘটেছিল তথা বাস্তব জীবনের পরিপূর্ণতা দানের জন্য রসুল (সা.) প্রেরিত হয়েছিলেন।
ব্যবহারিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক:
১.ব্যক্তি জীবন
২.পারিবারিক জীবন
৩.সামাজিক আচরণ
৪.কর্মজীবন
৫.আর্থিক জীবন
৬.সাংগঠনিক আচরণ
৭.দায়িত্বশীল সুলভ আচরণ
১. ব্যক্তি জীবন:
• নিয়তের একনিষ্ঠতা বা খুলুছিয়াত থাকা। এটা বান্দা না বুঝলেও আল্লাহ বুঝেন।
• কথা ও কাজে যাতে অন্য মানুষ কষ্ট না পায়। জবান বা বাকশক্তির হেফাজত করা। রসুল (সা.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি আমার নিকট তার দুচোয়ালের মধ্যবর্তী ও দুপায়ের মধ্যবর্তী স্থানের নিরাপত্তা দিতে পারবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব।”
• ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গঠন করা। প্রতিটি কাজের হক ঠিকমত পালন করার নাম হল ভারসাম্য। মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ১৪৩ নং আয়াতে বলেন “এভাবেই আমি তোমাদের এক মধ্যমপন্থী মানবদলে পরিণত করেছি, যেন তোমরা দুনিয়ার অন্যান্য মানুষের উপর (হেদায়াতের) সাক্ষী হয়ে থাকতে পারো (এবং একইভাবে) রসুল (সা.) তোমাদের সাক্ষী হয়ে থাকতে পারে।”
ইসলাম কৃপনতাকে সমর্থন করে না আবার অপচয়কেও সমর্থন করে না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) বলেছেন, দায়িত্বশীলদের জন্য ৪টি গুণ অপরিহার্য,
• কোমলতা, তবে দুর্বলতা নয়।
• দৃঢ়তা, তবে কঠোরতা নয়।
• স্বল্প ব্যয়িতা, তবে কৃপনতা নয়।
• দানশীলতা, তবে অপব্যয় নয়।
হযরত লোকমান (আ:) তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, নিজের চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর। আল্লাহ সুরা লোকমানের ১৯ নং আয়াতে বলেন “(হে বৎস জমিনে চলার সময়) তুমি মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর, তোমার কণ্ঠস্বর নিচু কর, কেননা আওয়াজ সমূহের মধ্যে সবচাইতে অপ্রীতিকর আওয়াজ হচ্ছে গাধার আওয়াজ।”
এক সাহাবী রসুল (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, চলন্ত ঝর্ণায় বেশি সময় ধরে অজু করতে পারবো কি? রসুল (সা.) বললেন না।
• রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা। রাগ মানুষকে সীমালঙ্ঘনের দিকে নিয়ে যায়। রাগের মাথায় কোন সিদ্ধান্ত ঠিক হয় না। রাগ প্রয়োজন মত থাকা দরকার, বেশি হলে বিপদ। উদাহরণ: পানির অপর নাম জীবন, বেশি হলে মরণ। মহান আল্লাহ সুরা হামিম আস সিজদাহর ৩৬ নং আয়াতে বলেন “যদি কখনো শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে তুমি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাও, অবশ্যই তিনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।”
মহান আল্লাহ সুরা আল ইমরানের ১৩৪ নং আয়াতে বলেন “যারা স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল সর্ব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ-ত্রæটি মাফ করে দেয়, এ ধরনের সৎলোকদের অত্যন্ত ভালোবাসেন।”
• জবান বা বাকশক্তির হেফাজত করা। মানুষের গুনাহ উল্লেখযোগ্য হয় জবান দ্বারা। আল্লাহ সুরা হুজরাতের ১২ নং আয়াতে বলেন “হে ঈমানদারগণ তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। এসব ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তওবা কবুল করেন ও অসীম দয়ালু।”
• দৃষ্টি শক্তির হেফাজত করা। আল্লাহ সুরা আন নুরের ৩০ নং আয়াতে বলেন “(হে নবী) তুমি মুমিন পুরুষদের বল তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযম করে রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করে, এটাই তাদের জন্য উত্তমপন্থা। তারা (নিজের চোখ ও লজ্জাস্থান দিয়ে) যা করে, আল্লাহ তায়ালা সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে অবহিত রয়েছেন।” এ ধরনের চোখে আগুনের সীসা ঢেলে দেওয়া হবে।
• রিয়া ও অহংকার মুক্ত জীবন গঠন। মহান আল্লাহ সুরা বনি ইসরাইলের ৩৭ নং আয়াতে বলেন “আল্লাহর জমিনে (কখনোই) দম্ভভরে চলো না, কেন না (যতই অহংকার কর না কেন) তুমি এ জমিন বিদ্বীর্ণ করতে পারবে না, আর উচ্চতায়ও তুমি কখনো পর্বত সমান হতে পারবে না।”
আল্লাহ সুরা মাউনের ৪-৭ নং আয়াতে বলেন “দুর্ভোগ রয়েছে সেসব নামাজির জন্য, যারা নিজেদের নামাজ থেকে উদাসীন থাকে, তারা কাজকর্মের বেলায় প্রদর্শনী করে এবং ছোট খাটো জিনিস পর্যন্ত (যারা অন্যদের) দিতে বারণ করে।”
হাদিসে এসেছে রসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, “গর্ব হলো আমার চাঁদর। যারা গর্ব করে তারা যেন আমার চাঁদর নিয়ে টানাহেচরা করে।”
• গীবত মুক্ত থাকা। মহান আল্লাহ সুরা হুজরাতের ১২ নং আয়াতে বলেন “হে ঈমানদারগণ তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং এঁকে অপরের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তাঁর মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। এসব ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তওবা কবুল করেন ও অসীম দয়ালু।”
• কটু কথা ও অশ্লীল কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকা।
• মিষ্টভাষী কোমল স্বভাব ও মিশুক চরিত্রের অধিকারী হওয়া। আল্লাহ সুরা ইমরানের ১৫৯ নং আয়াতে বলেন “এটা আল্লাহর এক (অসীম) দয়া যে, তুমি এদের সাথে ছিলে কোমল প্রকৃতির (মানুষ এর বিপরীতে) যদি তুমি নিষ্ঠুর ও পাষাণ হৃদয়ের হতে, তাহলে এসব লোক তোমার আশপাশ থেকে সরে যেত, অতএব তুমি এদের (অপরাধ সমূহ) মাফ করে দাও, এদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং কাজ কর্মের ব্যাপারে এদের সাথে পরামর্শ করো, অতএব (সে পরামর্শের ভিত্তিতে) সংকল্প একবার যখন তুমি করে নেবে তখন (তার সফলতার জন্য) আল্লাহর উপর ভরসা কর, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা (তার উপর) নির্ভরশীল মানুষদের ভালবাসেন।” (আল ইমরান-১৫৯)
• পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও রুচিসম্মত চলা। মহান আল্লাহ সুরা মুদ্দাসিসরের ৪ নং আয়াতে বলেন “আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছেদ পবিত্র কর।”
রসুল (সা.) বলেছেন, পবিত্রতা হলো ঈমানের অঙ্গ।
আদর্শিক আন্দোলনের কর্মীদের বই পুস্তক, পড়ার টেবিল, শোয়ার খাট, আলনা, কাপড়-চোপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও গোছালো রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজনে ঘর ঝাড়– দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার রাখা।
• মন্দের মোকাবিলায় উত্তমনীতি গ্রহণ করা। আল্লাহ সুরা হামীম সিজদাহ এর ৩৪ নং আয়াতে বলেন “(হে নবী) ভালো আর মন্দ কখনোই সমান হতে পারে না, তুমি ভাল দ্বারা মন্দ প্রতিহত কর তাহলেই তুমি দেখতে পাবে তোমার এবং যার সাথে তোমার শত্রæতা ছিল, তার মাঝে এমন (অবস্থা সৃষ্টি) হয়ে যাবে, যেন সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।”
• প্রকাশ্য ও গোপনীয় সকল গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। গোপনে খারাপ ও অশ্লীল বই না পড়া।
আল্লাহ সুরা আন নজমের ৩২ নং আয়াতে বলেন “(এটা তাদের জন্য) যারা বড় বড় গুনাহ থেকে এবং অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাকে, ছোটখাটো গুনাহ হলেও (তারা আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হবে না, কারণ) তোমার মালিকের ক্ষমার পরিধি অনেক বিস্তৃত, তিনি তোমাদের তখন থেকেই ভালো করে জানেন, যখন তিনি তোমাদের এ জমিন থেকে পয়দা করেছেন যখন তোমরা ছিলে মায়ের পেটে (ক্ষুদ্র একটি) ভ্রুনের আকারে, অতএব কখনো নিজেদের পবিত্র দাবি করো না, আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন কোন ব্যক্তি তাকে বেশি ভয় করে।”
• শোনা কথা পিছনে না বলা, কোন কথা শুনলে যাছাই বাছাই করা। আল্লাহ সুরা হুজরাতের ৬ নং আয়াতে বলেন “হে ঈমানদার ব্যক্তিরা যদি কোন দুষ্টলোক তোমাদের কাছে কোন তথ্য নিয়ে আসে, তবে তোমরা তার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখবে (কখনো যেন আবার এমন না হয়) না জেনে তোমরা কোন একটি সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে ফেললে এবং অতঃপর নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে তোমাদেরই অনুতপ্ত হতে হয়।”
• জনগণের জন্য ত্যাগ স্বীকার মন-মানসিকতা থাকা।
• সর্বদা মানুষের সেবার জন্য প্রস্তুত থাকা।
• আবেগ নিয়ন্ত্রণ রাখা।
• হাসিমুখে থাকা।
• আমানতদার হওয়া। যে ব্যক্তি নিজেকে এক পয়সার জন্য বিশ^স্ত প্রমাণ করতে পারে, সে এক লাখ টাকার আমানত গ্রহণের যোগ্য সাব্যস্ত হয়ে থাকে। (আমিন আহসান ইসলাহী)
• কথা ও কাজে গড়মিল পরিহার করা। মহান আল্লাহ সুরা আস সফ এর ২ ও ৩ নং আয়াতে বলেন “হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো যা নিজেরা করো না, আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো যা করো না।”
• কষ্ট সহিষ্ণু ও পরিশ্রম প্রিয় হওয়া।
• অল্পতে তুষ্ট হওয়া। সহজ-সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হওয়া।
• Time Management অভ্যস্ত/সময়ের সদ্বব্যবহার করা। সময় অপচয় না করা।
• কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলা আবশ্যক
√ কুরআনের কিছু আয়াত অর্থসহ প্রতিদিন মুখস্থ করা।
√ মেসওয়ার্ক করে নামাজ পড়া। যার দ্বারা ৭০গুণ সওয়াব বেশি পাওয়া যায়। খাবার পরে মেসওয়ার্ক, ঘুমানোর আগে মেসওয়ার্ক করা।
√ প্রথম রাতে আগে ঘুমিয়ে শেষ রাতে তাড়াতাড়ি উঠার চেষ্টা করা। ডান কাঁধে শোয়া।
√ শেষ রাতে নফল নামাজে অভ্যস্ত হওয়া।
√ সকালবেলা ঘুমানোর অভ্যাস পরিত্যাগ করা বা সকাল বেলায় হাঁটাহাঁটি বা শরীর চর্চায় অভ্যস্ত করা।
√ ফজরের নামাজ অবশ্যই জামাতে পড়তে হবে। এশা ও ফজরের নামাজ জামাতে পড়লে সারারাত ইবাদত বন্দেগীর সমান সওয়াব পাওয়া যায়।
২. পারিবারিক জীবন
• পিতামাতাকে কোন কষ্ট দেওয়ার ব্যাপারে সদা সজাগ থাকা। আল্লাহ সুরা বনি ইসরাইলের ২৩ নং আয়াতে বলেন “তোমার মালিক আদেশ করেছেন, তোমরা তাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো এবাদাত করো না এবং তোমরা তোমাদের পিতা-মাতার সাথে সদব্যবহার করো তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনিত হয় তাহলে তাদের সাথে বিরক্তি সূচক কিছু বলো না এবং কখনো তাদের ধমক দিওনা তাদের সাথে সম্মানজনক ভদ্রজনিত কথা বলো।”
বান্দার হকের প্রথম হল মা-বাবার হক। মায়ের দিকে একবার নেক নজরে তাকালে কবুল হজের সওয়াব পাওয়া যায়। নিয়মিত মা বাবাকে সালাম দেওয়ার অভ্যাস আমাদের সকলের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। যারা পিতা-মাতার নিকট থেকে দূরে অবস্থান করেন তাদের প্রতিদিন অন্তত একবার ফোন করে খোঁজ নেওয়া দরকার। বাড়িতে গেলে পিতা-মাতার সাথে একসাথে খাওয়া এবং যাওয়ার সময় সাধ্যানুযায়ী পিতা-মাতার জন্য প্রয়োজনীয় পরিধেয় সামগ্রী ও ব্যবহার্য বস্তু নিয়ে যাওয়া।
• পিতা-মাতার আত্মীয় স্বজনদের সাথে সদব্যবহার করা।
• ছোট ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ইসলাম সম্মত আচরণ করা। রসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ছোটদের ¯েœহ ও বড়োদের সম্মান করে না সে আমার দলভুক্ত নয়।” বড়োরা খারাপ আচরণ করলেও তাদের সাথে বেয়াদবি করা যাবে না।
• পরিবারের সদস্যদের নিকট সত্যপন্থি ও সত্যনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করা।
• মা-বাবা, ভাই-বোনসহ প্রত্যেকের হক আদায় করা।
• পরিবারের সকলের সাথে ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করা।
• কারোর প্রতি বেশি ঝুঁকে না পড়া।
• মুসলিম ফারায়েজের বিধানের আলোকে ভাই-বোনদের হক ঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া।
৩.সামাজিক আচরণ
• আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশির সাথে উত্তম ব্যবহার করা।
• ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক বজায় রাখা।
• জানাজা, বিয়েশাদীসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান করা।
• মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তা-ঘাট উন্নয়নের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা।
• রুগীর সেবা, অফিস আদালতে কাজের সহযোগিতা দেওয়া, ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনে গ্রামবাসীদের সহযোগিতা নিয়ে চেষ্টা করা।
• অন্য মানুষের কল্যাণ কামনা করা। দ্বীন মানেই হচ্ছে কল্যাণ কামনা করা।
• পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের সম্পর্ক বজায় রাখা। আল্লাহ সুরা হুজরাতের ১০ নং আয়াতে বলেন “মুমিনরা তো এঁকে অপরের ভাই অতএব (বিরোধ দেখা দিলে) তোমাদের ভাইদের মাঝে মিমাংসা করে দাও, আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের উপর দয়া ও অনুগ্রহ করা হবে।”
• পরস্পরের দোষ খুঁজে না বেড়ানো। আল্লাহ সুরা হুজরাতের ১২ নং আয়াতে বলেন “তোমরা একে অপরকে বিদ্রæপ করো না এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না।”
৪. কর্মজীবন
• নিজ কর্মজীবনের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করা।
• অধঃস্তনদের সাথে উত্তম আচরণ করা।
• যথাসময়ে কর্মস্থলে যাওয়া। অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।
• ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা।
• নিজেকে দায়ী ইলাল্লার ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করা।
৫. আর্থিক জীবন:
• সৎপথে উপার্জন করা। আয়ের ক্ষেত্রে অনৈতিক পথ ও পদ্ধতি অনুসরন না করা।
• আয় অনুপাতে ব্যয় করা, লেনদেনে ওয়াদা রক্ষা।
• অর্থ উপার্জনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন।
• উচ্চাকাঙ্খা না থাকা, আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হওয়া।
• নিকট আত্মীয়, প্রতিবেশী, গ্রামবাসীদের মধ্যে গরিব লোকদেরকে মাঝে সাধ্য অনুসারে দান করা।
• অতিদ্রুত বড়ো লোক হওয়ার আকাক্সক্ষা না করা।
• সাহেবে নেছাব হলে জাকাত ওশর আদায় করতে অভ্যস্ত হওয়া।
• কৃপনতা পরিহার করা।
• ঋণ মুক্ত থাকা।
৬. সাংগঠনিক আচরণ
• ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছায় নয় ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের পরামর্শ ও নিজস্ব টিমের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন পরিচালনা করা।
• সংগঠনের টাকা-পয়সা, সম্পদ, আমানত, ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলের অনুমতি ছাড়া কোন অবস্থাতেই নিজস্ব কাজে ব্যয় করা যাবে না।
• পরামর্শ গ্রহণে অনিহা ও একনায়ক সুলভ মনোভাব পরিহার করা।
• সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাড়াহুড়া ও ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত হওয়া পরিত্যাগ করা।
• মুহাসাবা গ্রহণে আগ্রহী থাকা।
• সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষমতা থাকা।
•অসতর্ক কথা বার্তা (নিষ্প্রয়োজন মন্তব্য, অহেতুক সমালোচনা) বলা পরিহার করা।
•পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।
• পার্থিব সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে স্বার্থহীন থাকা।
• জনশক্তিকে তার শিক্ষা, বয়স ও মাপকাঠি অনুযায়ী ব্যবহার করা।
• সবাইকে একই কাজ না দিয়ে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দেওয়া।
• সাংগঠনিক কাজের উপর ওজর পেশ না করা।
• দায়িত্বশীলদেরকে সম্মান দেওয়া।
• মুহাসাবাহ থাকলে নিয়ম মাফিক করা।
• গীবত না করা।
• দায়িত্বশীলকে পরামর্শ দেওয়া।
• ঠিকভাবে আনুগত্য করা।
• জনশক্তির প্রতি রুহামাও বায়নাহুম হওয়া। আল্লাহ সুরা ইমরানের ১৫৯ নং আয়াতে বলেন “এটা আল্লাহর এক (অসীম) দয়া যে, তুমি এঁদের সাথে ছিলে কোমল প্রকৃতির (মানুষ এর বিপরীতে) যদি তুমি নিষ্ঠুর ও পাষাণ হৃদয়ের হতে, তাহলে এসব লোক তোমার আশপাশ থেকে সরে যেত, অতএব তুমি এঁদের (অপরাধ সমূহ) মাফ করে দাও, এঁদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং কাজ কর্মের ব্যাপারে এদের সাথে পরামর্শ করো, অতএব (সে পরামর্শের ভিত্তিতে) সংকল্প একবার যখন তুমি করে নেবে তখন (তার সফলতার জন্য) আল্লাহর উপর ভরসা কর, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা (তার উপর) নির্ভরশীল মানুষদের ভালবাসেন।”
• নিজস্ব টিম ও অধঃস্তন দায়িত্বশীলদের পারিবারিক খোঁজখবর নেওয়া।
•জনশক্তির বিপদ আপদে পাশে দাঁড়ানো ও দিক নির্দেশনা দেওয়া।
• ত্যাগ কুরবানির ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হওয়া। এক্ষেত্রে
√ সময়ের ত্যাগ।
√ সম্পদের ত্যাগ।
√ কষ্টদায়ক বিষয় সহ্য করার ত্যাগ।
√ আকাক্সিক্ষত বস্তু লাভের ত্যাগ।
√ আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করার তামান্না থাকা।
৭. দায়িত্বশীল সুলভ আচরণ:
• সম্পদ বা সময়ের কুরবানি অন্যদের অনুপ্রেরণার পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে।
• দানের জগতে অগ্রগামী থাকতে হবে।
• সংবেদনশীল মন, দরদভরা অন্তর, মাধুর্যপূর্ণ ভাষা, শালীন আচরণ এবং ক্ষমা সুন্দর মানসিকতা দায়িত্বশীলদের বৈশিষ্ট্য।
• পদের আকাক্সক্ষী না হওয়া এবং পদকে পজিশনের বিষয় মনে না করে দায়িত্বের বোঝা মনে করা।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, দশজন মানুষের নেতা এমন ব্যক্তি কেয়ামতের দিন শিকল বাধা অবস্থায় আসবে। একমাত্র ন্যায়বিচার করে থাকলেই সে মুক্তি পাবে। (আমদ, আত তারগীব ওয়াত তারহীব-১১৭৭)
• অহংকার ও ব্যক্তিত্ব বিসর্জন।
• যোগ্যতার অহংবোধ পরিহার।
• সামগ্রিক বিষয়ে প্রশ্নবোধক মুক্ত চরিত্র।
• আল্লাহর দরবারে জবাবদিহীর মানসিকতা সহকারে দায়িত্ব পালন।
• আল্লাহর সাহায্য কামনা।
ব্যবহারিক জীবন উন্নত করার উপায়:
• রসুল (সা.) ও সাহাবীদের ব্যবহারিক জীবনকে সামনে রাখা।
• খারাপ ব্যবহারের জবাব উত্তম কথার দ্বারা দিতে হবে।
• মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে অন্তর দ্বারা বুঝার চেষ্টা করা।
• নিজে না করে অপরকে নির্দেশ না দেওয়া।
•ভারসাম্যপূর্ণ জীবন পরিচালনা করা। ছাত্র আন্দোলনের জনশক্তিদের সংগঠন ও পড়ালেখায় ভারসাম্য রক্ষা করা। পেশাগত, সাংগঠনিক ও পারিবারিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ভারসাম্য সাধন করা।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন