(গত পর্বের পরে)
৩৪. প্রোগ্রাম পরিচালনার দক্ষতা:
যে কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রাম প্রাণবন্ত ও সফল করার ক্ষেত্রে নেতার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আলোচ্যসূচির উপর পূর্বেই সম্যক প্রস্তুতি গ্রহণ এবং প্রোগ্রাম নির্দিষ্ট সময় শেষ করতে পারা নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বেশি সময় নিয়ে প্রোগ্রাম করা কিংবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রোগ্রাম; জনশক্তির মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততার ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
৩৫. নিস্ক্রিয়তার প্রতিকার করা:
কোন কারণে জনশক্তির মনে খটকা সৃষ্টি হওয়া, কারো আচরণে রুষ্ট হওয়া, পরিস্থিতির ভয়াবহতায় ভীত হওয়া, কোন অবাঞ্চিত ঘটনায় ব্যথিত হওয়া কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে কোন বড়ো রকমের সমস্যা সৃষ্টি হওয়াসহ নানা কারণে একজন জনশক্তি নিস্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় নেতৃত্বকে সংশ্লিষ্ট জনশক্তির সাথে দেখা করা, আলাপ আলোচনা করে কারণটি চিহ্নিত করে সমাধানের পরামর্শ দেওয়া এবং তাকে সক্রিয় করার প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন। সকল জনশক্তিকে ময়দানে সক্রিয় রাখতে পারা নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৩৬. মান উন্নয়ন ও মানসংরক্ষণের দক্ষতা:
জনশক্তির মানউন্নয়ন ও মানসংরক্ষণের বিষয়ে নেতৃত্বের দক্ষতা থাকতে হবে। সাহসী ও মৌলিক মানবীয় গুণাবলি সম্পন্ন জনশক্তিকে বাছাই করে মানউন্নয়নের জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে নেতাকে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে হবে। জনশক্তির আদর্শিক মান বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ ও জ্ঞানের ঘাটতি পূরণে নেতৃত্বকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে।
৩৭. পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দক্ষতা:
পরিকল্পনা প্রণয়নে নেতার দক্ষতার পাশাপাশি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একজন নেতাকে দক্ষ হতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজের অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করা, পরিকল্পনা বণ্টন করা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সকল পর্যায়ের জনশক্তিকে সম্পৃক্ত করা এবং সঠিকভাবে তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে নেতাকে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।
৩৮. পেশাভিত্তিক মজবুত সাংগঠনিক কাঠামো গঠনে দক্ষতা:
শ্রমিক আন্দোলনে পেশাভিত্তিক কাজের গুরুত্ব অত্যাধিক। পেশাভিত্তিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদেরকে সহজেই সংগঠিত করা যায়। একজন শ্রমিক নেতাকে তার সাংগঠনিক এলাকায় সকল পেশার শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ‘যত পেশা ততো কমিটি’ এবং ‘যত পেশা ততো ট্রেড ইউনিয়ন’ এ ¯েøাগানকে সামনে রেখে তৃণমূল পর্যন্ত পেশাভিত্তিক কমিটি গঠন, সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও ট্রেড ইউনিয়নে গঠনে একজন শ্রমিক নেতাকে সর্বদা তৎপরতা থাকতে হবে।
৩৯. মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান:
একজন কাক্সিক্ষত মানের শ্রমিক নেতা অধীনস্তদের চিন্তার স্বাধীনতা প্রদান করবেন। অধীনস্তদের মতামত ও চিন্তাকে গুরুত্ব দিবেন। বড়ো ধরনের ক্ষতি না হলে অন্যের মত গ্রহণ করে উৎসাহ দেওয়া উচিত। মত প্রকাশের উপযুক্ত সুযোগ ও পরিবেশ পেলে নেতৃত্বের প্রতি জনশক্তির আকর্ষণ ও আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।
৪০. প্রেরণাদায়ক বক্তৃতা প্রদানের দক্ষতা:
কোন কোন ক্ষেত্রে একটি বক্তব্য জাদুর মতো কাজ করে। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথাও সংক্ষেপে সুন্দর করে বক্তৃতার মাধ্যমে উপস্থাপন করা সম্ভব। বক্তৃতার ভাষা হবে সহজবোধ্য। এতে থাকবে বলিষ্ঠতা ও জনশক্তিদের উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা।
৪১. শ্রমিক দরদি হওয়া:
একজন শ্রমিক নেতাকে অবশ্যই শ্রমিকদের প্রতি দরদি মনোভাব পোষণ করতে হবে। শ্রমিকদের কষ্টগুলোকে উপলব্ধি করার মত দরদি মন নেতার মধ্যে তৈরি হতে হবে। তাদের সমস্যাগুলো সমাধানে নেতাকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাদের দুঃখ কষ্টে নেতাকে সহানুভূতিশীল হওয়া এবং সহযোগিতার বিষয়ে উদ্যোগ করার মানসিকতা লালন করতে হবে।
৪২. প্রশস্ত মনের অধিকারী হওয়া:
নেতৃত্বের লোভ ও মতামত কুরবানি করতে না পারার কারণে এক সংগঠন থেকে আরেক সংগঠনের সৃষ্টি হয়। নেতৃত্বের প্রশস্ত মন-মানসিকতা একদিকে সংগঠনকে বেগবান করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে, অন্যদিকে নেতৃত্বের সংকীর্ণ মানসিকতা সংগঠনের জন্য অনেকাংশে ক্ষতির কারণ হয়। সকল ক্ষেত্রে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে একমাত্র সঠিক মনে করে তার উপর অটল থাকা কাক্সিক্ষত মানের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
৪৩. দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হওয়া:
একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতা পরিকল্পিতভাবে কাজ করবেন। লক্ষ্য নির্ধারণ করে ভূমিকা রাখবেন। সংগঠন কোথায় কোথায় সম্প্রসারন করা প্রয়োজন, কত ইউনিট বৃদ্ধি করতে হবে, আর্থিক স্বচ্ছলতা কতটুকু বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, প্রয়োজনীয় উপকরণ কী কী সংগ্রহ করা দরকার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের তালিকা তৈরি করে তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করা তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সংগঠনকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান সে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে ভূমিকা রাখা একজন কাক্সিক্ষত নেতার অন্যতম গুণাবলি।
৪৪. জনশক্তি পরিচালনায় বিচক্ষণতা:
একজন নেতাকে সকল জনশক্তিকে নিয়ে সংগঠনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। জনশক্তির নিকট থেকে কাজ আদায় করতে হবে প্রেরণা ও উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে জনশক্তির আন্তরিক আনুগত্য পাওয়া যায়। জনশক্তি পরিচালনায় Dependence এবং Independence (স্বাধীনতা) দুটি ক্ষতিকর। (Dependence) হলে জনশক্তির কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি Grow পাবে না আবার Independence হলে কাজ করার পদ্ধতি বুঝবে না। Autonomy(ব্যক্তি স্বাধীনতা) কিংবা Freedom না পেলে কেউ Grow করে না। এ দিক কে সামনে রেখে নেতাকে জনশক্তি পরিচালনায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
৪৫. শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস জানা
যে কোন আন্দোলনের নেতৃত্ব পর্যায়ের ব্যক্তিদেরকে সে আন্দোলনের ইতিহাস যেমন জানা জরুরি; তেমনি শ্রমিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখা নেতৃবৃন্দকে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে কম-বেশি পড়ালেখা করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা শ্রমিক আন্দোলন সমূহের সফলতা সম্পর্কে যেমন ধারণা অর্জিত হবে তেমনি কোন কোন কারণে বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিলো সে সম্পর্কেও অবগত হওয়া যাবে। শ্রমিক আন্দোলনের নানারূপ চড়া-উতরাই, উত্থান-পতন, নির্যাতন, নিষ্পেষন, জেল-জুলুম সম্পর্কেও জানার সুযোগ তৈরি হবে। আন্দোলনের সফলতার জন্য একজন শ্রমিক নেতার ইতিহাস সম্পর্কে অবগত থাকা আবশ্যক।
৪৬. বিভিন্ন দেশের শ্রমিক সংগঠন ও তাদের কার্যক্রম সংক্রান্ত ধারণা রাখা:
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমিক সংগঠনগুলো কিভাবে ভূমিকা পালন করছে, তাদের আন্দোলনের সফলতার দিকসমূহ এবং তাদের কার্যক্রম সংক্রান্ত দিকগুলো জানার মধ্য দিয়ে একজন শ্রমিক নেতা নিজেকে আরও দক্ষ করে গড়ে তোলার সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করা এবং তাদের ডবনংরঃব ভিজিট করে প্রয়োজনীয় ধারণা নেওয়ার সুযোগ আছে।
৪৭. মালিক ও শ্রমিকদের মাঝে সেতুবন্ধনে দক্ষতা:
শ্রমিক-মালিকের পারস্পরিক সম্পর্কের সেতু বন্ধন শ্রম সেক্টরে কাক্সিক্ষত কর্মপরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। শ্রমিক-মালিকের মাঝে সৃষ্টি হওয়া দ্বন্দ্ব নিরসনে শ্রমিক নেতার মাঝে দক্ষতা থাকতে হবে। ‘শ্রমিক-মালিক ভাই ভাই, আলাপ-আলোচনায় সমাধান চাই’ এ স্লোগানকে বাস্তবায়নে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে মালিকের সাথে শ্রমিকের দূরত্ব কমিয়ে আনতে নেতাকে ভূমিকা রাখতে হবে।
৪৮. শ্রমিকদেরকে দায়িত্ব সচেতন করা:
মালিকের প্রতি একজন শ্রমিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে শ্রমিকদেরকে সচেতন করার বিষয়ে নেতাকে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। চুক্তি মোতাবেক প্রদত্ত কাজ নিষ্ঠা ও বিশ^স্ততার সাথে সম্পাদন করা, আমানতদারিতার সাথে দায়িত্ব পালন করা, মালিকের সম্পদ চুরি না করা, কাজে গাফিলতি না করা, মালিকের সাথে কোনরূপ প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ না করা ইত্যাদি দিকসমূহের ব্যাপারে শ্রমিক নেতৃত্বকে অবগত থাকার পাশাপাশি শ্রমিকদেরকে বুঝানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
৪৯. মালিকদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা:
শ্রমিকদের আইন সংগতভাবে প্রাপ্ত অধিকারের বিষয়ে মালিকদের সচেতন করার দায়িত্ব শ্রমিক নেতৃত্বকে পালন করতে হবে। শ্রমিকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান, কাজের পূর্বে মজুরি নির্ধারণ, কাজ শেষে বিলম্ব ব্যতিরেকে মজুরি পরিশোধ করা, শক্তি/সামর্থ্যরে বাইরে কাজ না করানো, ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের ব্যাপারে স্বাধীনতা, ছুটি প্রদান করা ইত্যাদি বিষয়ে একজন নেতাকে অবগত থাকার পাশাপাশি মালিকদের সচেতন করে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করা একজন কাক্সিক্ষত মানের শ্রমিক নেতার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
৫০. অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী হওয়া:
সাংগঠনিক কাজে অগ্রগতির ক্ষেত্রে কোন সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানের ক্ষেত্রে শ্রমিক নেতৃত্বকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে তাকে বেশি বেশি ভাবতে হবে। তিনি নতুন নতুন চিন্তা পেশ করবেন, নতুন নতুন কর্মকৌশল উদ্ভাবন করবেন। মোদ্দাকথা হল চিন্তা ও কাজ উভয় ক্ষেত্রেই নেতার ভূমিকা হবে অগ্রণী।
৫১. সময় ব্যবস্থাপনায় পারদর্শিতা:
সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একজন নেতাকে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষেত্রে সময় সচেতনতা, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করার প্রবণতা, কাজকে অগ্রাধিকারের আলোকে বিন্যাস করা এবং সকল কিছুর মধ্যে ভারসাম্যতা বজায় রাখা নেতৃত্বের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।
শ্রমিক নেতৃত্বের আদর্শিক বৈশিষ্ট্য
১। সততা
একজন শ্রমিক নেতাকে অবশ্যই সততার বাহক হতে হবে। যে নেতার মাঝে যে পরিমাণ ‘কথা ও কাজের মিল’ পাওয়া যায় তাকে সে পরিমাণ সৎ বলে মনে করা হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ বিষয়ে বলেছেন, ‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা তোমরা করো না? তোমরা যা করো না, তোমাদের সে কথা বলাটা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক।” (সুরা আস্ সফ ২-৩)
একজন শ্রমিক নেতার মধ্যে যদি সততার গুন না থাকে, নেতার মধ্যে যদি কপটতা থাকে, নেতা নিজেই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে তার নেতৃত্ব কখনো সফল হয় না এবং সাধারণ শ্রমিকরা অসৎ নেতৃত্বের অধীনে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারিত হয়।
২। আমানত প্রবণতা
আমানতের সঠিক হেফাজত নেতার একটি অপরিহার্য গুন। একজন মুমিনের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খিয়ানতকারীদের কথায় কেউ আস্থা রাখে না। ফলে একজন শ্রমিক নেতার মাঝে বিশ^স্ততা ও আমানতদারিতার বৈশিষ্ট্য থাক আবশ্যক। আর্থিক লেনদেন পরিচ্ছন্ন ভূমিকা পালন করা, আয়-ব্যয় ভারসাম্য বজায় রাখা, ওয়াদা মাফিক লেন-দেন পরিশোধ করা আমানতদারিতার অন্যতম দিক। সংগঠনের সম্পদ, অর্থ, জনশক্তি, নেতৃত্বের নিকট বড় আমানত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা জেনে শুনে আল্লাহ এবং রাসূলের খিয়ানত করো না এবং তোমাদের পরস্পরের আমানতেরও খিয়ানত করো না।’ (সুরা আনফাল ২৭) রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই’ (মুসনাদে আহমাদ)। একজন নেতাকে দ্বীনের আমানত, দায়িত্বের আমানত, আর্থিক আমানত, জিহŸার আমানত, কথার আমানত, পরামর্শের আমানত, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার আমানতসহ সকল ধরনের আমানতের সংরক্ষণের ব্যাপারে মনোযোগী থাকতে হবে।
৩। ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষতা
একজন নেতার অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ ও নিরপেক্ষ হওয়া আবশ্যক। নেতৃত্বকে ন্যায়বিচার কায়েম ও ইনসাফের চৎধপঃরপব করতে হবে। জনশক্তির সাথে ইনসাফপূর্ণ ও পক্ষপাতহীন আচরণ করতে হবে। অধস্তনদের সাথে ইনসাফ কায়েম করার ক্ষেত্রে সংগঠনের নীতিমালা ও নিয়মকানুন অনুসরণ করা প্রয়োজন। এতে সংগঠনের ভিত্তি সুদৃঢ় হয় এবং কর্মীদের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়। নেতাকে সকল পর্যায়ে ন্যায় কথা, ন্যায় সিদ্ধান্ত, ন্যায় নির্দেশ ও ন্যায় আচরণে অভ্যস্ত হতে হবে। যে নেতৃত্ব অধস্তনদের মাঝে ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয় বা সবাইকে সমান নজরে দেখতে না পারে তার পক্ষে কার্যকর নেতৃত্ব দান করা সম্ভব হয় না। মনে রাখতে হবে ন্যায়পরায়ণতার গুণ অধস্তনদের মাঝে নেতার গ্রহণযোগ্যতা ও মান মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
৪। জবাবদিহির অনুভূতি সক্রিয় থাকা
ইসলামে নেতৃত্বের জিম্মাদারী অনেক কঠিন। সেজন্য যার উপর দায়িত্ব বর্তাবে সে অনেকটা মজলুমের মতো। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার তত্ত্বাবধান (দায়িত্ব) সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। নেতা একজন তত্ত্বাবধায়ক এবং এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি, মুসলিম)। হক আদায় করে দায়িত্বপালন না করলে পরকালে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোন বান্দাকে যদি আল্লাহ জনগণের নেতৃত্ব প্রদান করে, আর সে যদি কল্যাণ কামনার সঙ্গে তাদের তত্ত্বাবধান না করে (অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে) তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (বুখারি)
রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ১০ জন লোকের উপরও নেতৃত্ব দিয়েছে সে আসামি হিসেবে গণ্য হবে। কোন অভিযোগ না থাকলে সে ছাড়া পাবে। একজন আদর্শিক নেতাকে কুন্ঠাহীনভাবেই এই জবাবদিহির জন্য প্রস্তুত থাকেন।
৫। আত্মসমালোচনার অভ্যস্ততা
একজন দায়িত্বশীল নেতাকে অবশ্যই আত্মসমালোচনায় অভ্যস্ত হতে হবে। প্রতিদিন কাজের শেষে গভীর রাতে কর্মময় দিনের জন্য চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। ভালো কাজের জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় এবং মন্দ কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
৬। বিনয় ও কোমলতার গুণে গুণান্বিত হওয়া
বিনয় ও কোমলতা সকল নেতার অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য। নেতার হৃদয় হবে কোমল, ভাষা হবে মধুর, মেজাজ হবে শীতল। নেতৃত্ব জনশক্তিকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দানকারী হবেন। কঠোরতা মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়। তাই নেতৃত্বকে কঠোরতা পরিহার করতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, আপনি আপনার অনুসারী মুমিনদের জন্য আপনার স্নেহের বাহু বিস্তৃত করে দিন।
হযরত আয়াজ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, একদিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ আমার কাছে এসে বলেন, বাপু হে শোন। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তি হলো রাগী, বদমেজাবী ব্যক্তি। খবরদার আমি তোমাকে সাবধান করছি, তুমি যেন তাদের দলমুক্ত না হও। (বুখারি ও মুসলিম)
৭। শ্রমজীবী মানুষের নিকট অনুকরণযোগ্য হওয়া
একজন শ্রমিক নেতাকে ভাল মানুষ হিসেবে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের শ্রদ্ধা অর্জনের যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। নেতার মর্যাদা পাওয়ার বিষয়ে খেয়াল রাখার পাশাপাশি জ্ঞান ও আমলে অনুকরণযোগ্য হতে হবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।