পদ্মা, যমুনা ও মেঘনার মত বৃহৎ নদীগুলোর পলিমাটি আশীর্বাদপুষ্ট গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি এই কৃষি প্রাচুর্যের দেশ বাংলাদেশ যে শিল্পের কার্যকরী ও সুযোগ্য সুযোগে কৃষি মাতৃক দেশ হতে শিল্পনির্ভর দেশের তকমার দিকে সদর্পে হাঁটাহাঁটি করে এগিয়ে যাচ্ছে সেই শিল্পের আভিধানিক উপমাই হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। বল চলে, এই তৈরি পোশাকশিল্পই বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পোশাক তৈরি ও রফতানিকারকের গর্বের তকমা এবং কর্মসংস্থান করেছে লাখ লাখ গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের আর বাংলাদেশকে করেছে সুস্থিতিশীল, স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাশীল অর্থনীতির দেশে। বলা চলে, তৈরি পোশাকশিল্প বর্তমানে বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পখাতগুলোর একটি, যা থেকে বাংলাদেশ তার রফতানি আয়ের ৭৫% অর্জন করে এবং উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তৈরি পোশাকশিল্প ও পেছনে ফিরে তাকানো
তৈরি পোশাকশিল্পের আওতায় বাংলাদেশ প্রধানত বিভিন্ন ধরনের উন্নত, মাঝারি পোশাক, একসেসরিজ তৈরি করে থাকে এবং তা খুব সহনীয় মূল্যে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সুনামের অন্যতম ইউনিক কারণ হলো ‘কম দামে উৎকৃষ্ট মানের পোশাক’। মূলত স্বাধীনতা পরবর্তী সত্তর দশক হতেই তৈরি পোশাকশিল্পের গোড়াপত্তন বাংলাদেশে। কিছু উদ্যোগপ্রিয় সাহসী উদ্যোক্তা সত্তর দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রামে মোহাম্মদী গ্রুপের মাধ্যমে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তৈরি পোশাক বিদেশে রফতানি শুরু করেন, যা পরবর্তীতে বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাংলাদেশ নব্বই দশকে প্রথমবারের মত প্রাতিষ্ঠানিক পোশাক রফতানিকারকে পরিণত হয় যেখানে সরকারি-বেসরকারি অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় তা আজ দেশের মোট বৈদেশিক আয়ের ৮০% পূরণ করছে। যা পরিসংখ্যানিকভাবে দেশের রফতানি আয়ের ৮১.১৩%। দেশের গ্রাম ও মফস্বলের এক বিশাল যুব অংশ বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত। ১৯৮৪ সালে যাত্রার শুরুর দিকে মাত্র ০.১২ মিলিয়ন মানুষ এই শিল্পে জড়িত ছিল যেখানে বর্তমানে বাংলাদেশের ৪ মিলিয়ন মানুষ পোশাক তৈরি শিল্পের সাথে কোনো না কোনাভাবে জড়িত। সূত্র (বিজিএমইএ, ২০১৪)। অপর দিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন মতে, ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন দক্ষ কর্মীর চাহিদায় পৌঁছাবে যা দেশের সার্বিক কর্মসংস্থানের চিত্রই বদলে দিবে। এক গবেষণা মতে, বর্তমান বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে দারিদ্র্য হার কমা ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ামক ভূমিকা রাখছে।
বর্তমান পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ
অব্যাহত অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের বর্তমান টার্গেট চীনকে সরিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পে প্রথম স্থান দখলে নেয়া। যা এই অঞ্চলে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থাকেই পাল্টে দিবে। ২০১৩ সালে সংঘটিত ভয়াবহ রানাপ্লাজা ধ্বংস ও শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ইমেজ সংকটে পড়ে। বহির্বিশ্বে ভুল বার্তা যায়। ফলে পোশাক রফতানি খানিকটা ধসে পড়ে। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত সহযোগিতা ও বিদেশী ক্রেতাদের সার্বিক অংশগ্রহণে দ্রুতই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিদেশী ক্রেতারা Accord ও Alliance নামে দুইটি স্বাধীন পরিদর্শন সংস্থা গড়ে তোলে যারা নিয়মিত পরিদর্শন, পরামর্শ ও আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা খুঁজে বের করে এবং শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ফলে ৩ বছরের মাথায় কারখানাগুলোর পরিবেশে গুণগত, পরিবেশগত, ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন আসে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি সবুজ কর্মপরিবেশের কারখানার মধ্যে ৭টিই বাংলাদেশে অবস্থিত। উপরন্তু শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সকল কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালু পূর্বক উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের ন্যায্যতাভিত্তিক অংশগ্রহণ ও প্রাপ্যতায় এই দুইটি সংগঠন Accord ও Alliance কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচার ও এক্সপোটার্স (বিজিএমইএ) সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ও সরকারের প্রণোদনায় রানাপ্লাজা পরবর্তী সংকট বাংলাদেশ সফলভাবে কাটিয়ে উঠেছে।
সম্ভাবনার তৈরি পোশাকশিল্প
বর্তমান বাংলাদেশে পোশাকশিল্প একটি শক্ত ভিত্তি মূলে দাঁড়িয়ে গেছে। বেসরকারি বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা ও সরকারি কার্যকর সহযোগিতায় পোশাকশিল্প বাংলাদেশের প্রধানতম রফতানি আয়ের উৎস। সরকার পরিকল্পনা করছে ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক রফতানিমূল্য ৫০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার। এই লক্ষ্যে সরকার দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ সহজ করতে বিনিয়োগ বোর্ডকে যুগোপযোগী বিনিয়োগ সহায়ক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। অর্থনীতির থিংকট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) হিসাব মতে, বিশ্ব রফতানিতে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ৫ শতাংশ। একে আরও বিবেচনাযোগ্য করতে তৈরি পোশাকশিল্প প্রধান চালিকাশক্তি হবে। সরকারি পরিকল্পনা ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩ বছর বিভিন্ন গার্মেন্টস রিলিটেড প্রদর্শনী আয়োজন করা হচ্ছে। যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগকারী ও দেশীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে যোগাযোগের মেলবন্ধন ঘটানো। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে তুলে ধরতেও এই সম্মেলন প্রদর্শনীগুলো প্রচারণা হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়
বিশ্ব বিনিয়োগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান Goldman Sachs এর মতে, বাংলাদেশ `Next 11` এর অন্তর্ভূক্ত রাষ্ট্র যে ১১টি দেশ সামনের দিনগুলোতে উদীমান অর্থনীতিতে পরিণত হবে। অপর দিকে JP Morgan এর লিস্ট মতে বাংলাদেশ বিশ্ব উদীমান অর্থনীতির Frontier Five এর অন্তর্ভূক্ত রাষ্ট্র। এই আলোকে বাংলাদেশকে নিজস্ব কর্মকৌশল ও বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
* সরকার সারা দেশে ১০০টি Economic Zone প্রতিষ্ঠা করছে। যাতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সহজেই জমি পাবে এবং কারখানা স্থাপন করতে পারবে।
* তৈরি পোশাকশিল্পে সরকার অগ্রাধিকারভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সুবিধা প্রদান করছে।
* দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেকোনো বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের মূল পূর্বশর্ত। তাই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে অভিন্ন রাজনৈতিক নীতি আবশ্যক।
* দেশে তৈরি পোশাকের বহুমুখীকরণ আবশ্যক। যাতে করে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে পোশাকের যথাযথ মূল্য নির্ধারিত হতে পারে।
* বিদেশী দেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার সুযোগ দেয়ার জন্য দেশে বিভিন্ন এক্সিবিশন, সিম্পোজিয়াম, প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিয়ে ব্র্যান্ড ইমেজ গড়ে ওঠে।
* তৈরি পোশাকশিল্পে দক্ষ শ্রমিক তৈরির জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, দক্ষ শ্রমিক উৎকৃষ্ট উৎপাদনের প্রেরণা।
* দেশের সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিক এবং গতিশীল করে গড়ে তুলতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, মংলা ও পায়রা বন্দরকে পূর্ণ কাজে লাগাতে হবে। যাতে করে শিল্পের কাঁচামাল ও তৈরি পোশাক দ্রুত তাদের কাক্সিক্ষত স্থলে পৌঁছতে পারে।
* ঢাকা ও চট্টগ্রাম রেলপণ্য যোগাযোগ বাড়াতে হবে। যাতে করে রেলপথে দ্রুত চালান চট্টগ্রামে পৌঁছানো যায়। তা ছাড়া ট্রেলারবাহী চালান দ্রুত গাজীপুর পৌঁছানোর স্বার্থে জয়দেবপুর পর্যন্ত উন্নত, দ্রুত রেল পরিষেবা চালু করতে হবে।
* বিদেশী বিনিয়োগকারী যাতে তাদের বিনিয়োগলব্ধ অর্থের লভ্যাংশ নিরাপদ ও দ্রুত তাদের কাছে নিয়ে যেতে পারে তার জন্য দ্রুত, হ্যাসেল মুক্ত বিনিয়োগবন্ধব আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
* তৈরি পোশাকশিল্পের সাথে জড়িত নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একই ছাদের নিচে আনতে ‘‘ওয়ান স্টপ’’ সার্ভিস প্রণয়ন করে তা সরকারি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দক্ষ তদারকি করতে হবে।
সমাপ্তি
বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ এখন উদীয়মান সম্ভাবনা যার মূল ভিত্তি তৈরি পোশাকখাত। তৈরি পেশাক খাত শুধু একটি শিল্প নয় বরং কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের স্বপ্ন এবং জাতির স্বনির্ভর এক বিশ^স্ত হাতিয়ার।
প্রবন্ধটি ‘ত্রৈ-মাসিক শ্রমিক বার্তা’র প্রথম সংখ্যা (অক্টোবর-ডিসেম্বর-২০১৭) তে প্রকাশিত হয়েছে।