বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবারো ফিরে এসেছে পবিত্র ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। সারা বিশ্বে মুসলমানরা হিজরী বর্ষের দ্বাদশ মাস জিলহজ্বের ১০ তারিখে ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ উদযাপন করে। আরবের অনেক দেশে একে বড় ঈদ বা ঈদুল কুবরাও বলা হয়ে থাকে। অন্যান্য দেশেও এর নিজস্ব ভিন্ন নামও রয়েছে তবে এর অর্থ ও তাৎপর্য অভিন্ন। মহান আল্লাহতা’য়ালার আদেশে হযরত ইবরাহীম (আ)এর নিজ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ)কে আল্লাহর জন্য কুরবানী করার ইচ্ছা ও ত্যাগের কারণে সারা বিশ্বের মুসলমানেরা আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করে দেয়ার লক্ষ্যে পবিত্র হজ্বের পরের দিন ঈদুল আযহা উদযাপন ও পশু কুরবানী করে থাকে। আল্লাহ তা’য়ালা ইবরাহীম (আ) এর আনুগত্যে সন্তুষ্ট হন এবং পুত্রের পরিবর্তে তাকে পশু কুরবানী করার নির্দেশ দেন। ইবরাহীম (আ) এর সে সুন্নাত অনুসরণে ঈদুল আযহার সময় মুসলমানরা পশু কুরবানী করেন।
ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদের পরিচয়:
ঈদ শব্দের অর্থ অভিধানে যা পাওয়া যায় তার মধ্যে উৎসব, খুশির দিন এবং যা বার বার আসে অন্যতম। আর আযহা অর্থ কুরবানী, ত্যাগ, উৎসর্গ বা কুরবানীর পশু ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে কুরবানীর বদলে ‘কুরবান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হাদীছেও ‘কুরবানী’ শব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে এর পরিবর্তে ‘উযহিয়াহ’ ও ‘যাহিয়া’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।আর এজন্যই কুরবানীর ঈদকে ‘ঈদুল আযহা’ বলা হয়। আরবী ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসী বা উর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে-নৈকট্য, সান্নিধ্য, উৎসর্গ ইত্যাদি। উল্লিখিত শব্দ এবং অর্থগুলো থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ত্যাগ বা বিসর্জন অর্থাৎ কুরবানীকে ভিত্তি করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের যে সুনির্দিষ্ট আনন্দময় অপার সুযোগ তাকেই ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ বলে। পারিভাষিক অর্থে ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়।আর প্রচলিত অর্থে পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে জিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরয়ী তরীকায় নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির পশু যবাই করাকে কুরবানী বলা হয়। সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময়ে ‘কুরবানী’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ বলা হয়ে থাকে।
মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানী:
মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানী হযরত আদম (আ) এর দু’পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। এ ঘটনাটি বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী সনদ সহ বর্ণিত হয়েছে। ইবনে কাসীর একে ওলামায়ে মোতাকাদ্দেমীন ও ওলামায়ে মোতায়াখ্খেরীনের সর্ব সম্মত উক্তিবলে আখ্যা দিয়েছেন। আদম (আ) ও হাওয়া (আ) এর পৃথিবীতে আগমনের মধ্যদিয়ে পৃথিবীতে বিস্তার সন্তান প্রজনন ও আরম্ভ হয়। তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ যমজ সন্তান জন্ম গ্রহণ করত। এমতাবস্থায় এক শ্রেণীর ভাই বোন ছাড়া হযরত আদমের আর কোন সন্তান ছিলনা। অথচ ভাই বোন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তাই মহান আল্লাহ উপস্থিত প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে আদম (আ) এর শরীয়তে বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পরের সহোদর ভাইবোন গন্য হবে। সুতরাং তাদের মধ্যে পরস্পর বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভের কন্যা সহোদরা বোন গণ্য হবে না। তাই তাদের পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে। কিন্তু ঘটনাক্রমে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোনটি ছিল খুবই সুশ্রী সুন্দরী তার নাম ছিল ‘আকলিমা’। আর হাবিলের সহজাত বোনটি ছিল তুলনামূলক কম সুন্দরী তার নাম ছিল ‘গাজা’। বিবাহের সময়ে হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত অসুন্দরী কন্যা কাবিলের ভাগে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শক্র হয়ে গেল। সে জেদ ধরল যে, আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। হযরত আদম (আ) তাঁর শরীয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন।
অতঃপর তিনি হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা উভয়েই আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কুরবানী পেশ কর। যার কুরবানী গৃহীত হবে, সেই উক্ত কন্যার পানি গ্রহণ করবে। হযরত আদম (আ) এর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, যে সত্য পথে আছে ,তার কুরবানীই গৃহীত হবে। সে সময়ে কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নি শিখা এসে কুরবানীকে ভস্মীভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেত। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:
‘ঐ কুরবানী যাকে আগুন (অদৃশ্য থেকে এসে) গ্রাস করে নিবে’- (আলে ইমরানঃ ১৮৩)।আর যে কুরবানীকে অগ্নি ভস্মীভূত করত না, সেটাকে প্রত্যাখ্যাত গণ্য করা হত। কুরবানীর এ পদ্ধতি সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর যুগ পর্যন্ত সকল পূর্বেকার নবীর যুগে বলবৎ ছিল। হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু পালন করত। সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কুরবানী করল। কাবিল কৃষি কাজ করত। সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কুরবানীর জন্যে পেশ করল। অতঃপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নি শিখা অবতরণ করে হাবিলের কুরবানীটি ভস্মীভূত করে দিল এবং কাবিলের কুরবানী যেমন ছিল তেমনি পড়ে রইল। এ অকৃতকার্যতায় কাবিলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না। তাই সে হাবিলকে হত্যা করার সংকল্প করল এবং এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করে ফেলল।
হাবিল ও কাবিলের কুরবানীর ঘটনা পবিত্র কুরআনে এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে-
‘আপনি তাদেরকে আদমের দু’ পুত্রের ঘটনাটি সঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। তা হচ্ছে এই যে,যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করলো, তখন তাদের একজনের কুরবানী গৃহীত হল আর অপর জনের কুরবানী গৃহীত হলোনা। তখন সে ভাইকে বলল অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। সে উত্তরে বলল আল্লাহতো মুত্তাকীদের কুরবানীই কবুল করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হস্ত প্রসারিত করব না। নিশ্চয়ই আমি বিশ্ব জগতের পালনকর্তা মহান আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অতঃপর তুমি দোযখীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি। অতঃপর তার অন্তর তাকে ভ্রাতৃ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। অনন্তর সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতি গ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। আল্লাহ এক কাক প্রেরণ করলেন। সে মাটি খনন করছিল যাতে তাকে শিক্ষা দেয় যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ সে কিভাবে সমাহিত করবে। এ দৃশ্য দেখে সে বললো, হায় আফসোস! আমি এ কাকটির মতোও হতে পারলাম না যাতে নিজের ভাইয়ের লাশটিও লুকাতে পারি। এরপর নিজের কৃতকর্মের জন্য সে খুবই অনুতপ্ত হলো’: (আল মায়িদাহঃ২৭-৩১)।
কুরবানীর ধারাবাহিকতা ও বাধ্যবাধকতা:
কুরবানীর ইতিহাস ততোটাই প্রাচীন যতোটা প্রাচীন মানব অথবা ধর্মের ইতিহাস। কুরবানী নামক এ মহান নিদর্শন আদম (আ) এর পর থেকে মানব জাতির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত সকল শরীয়তেই কার্যকর ছিলো। সকল নবীর উম্মতের মধ্যেই অবিচ্ছিন্ন ভাবে কুরবানীর ধারাবাহিকতা চলে আসছে তথা সকল নবীর উম্মতকেই কুরবানী করতে হয়েছে। প্রত্যেক নবীর উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোন না কোন ভাবে আল্লাহরদরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে । এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব বা ফিতরাত।
এ ফিতরাতের স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছেন। ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন(সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন’- (হজ্জ্বঃ৩৪)।
আমাদের কুরবানী সুন্নাতে ইবরাহীমী:
আমাদের উপর যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ হযরত ইবরাহীম (আ) কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাঈল (আ)কে আল্লাহররাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে চালু হয়েছে। মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম ও ইসমাঈল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ঈদুল আযহা’ বা কুরবানীর ঈদ। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ) যেমন আল্লাহর নির্দেশে জীবনের সবচাইতে প্রিয় বস্তু পুত্র ইসমাঈলকে তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করতে প্রস্তুত ছিলেন, ঈদুল আযহার দিন মুসলমানরাও তেমনি পশু কুরবানীর মাধ্যমে নিজেদের প্রিয়তম জানমাল আল্লাহর পথে কুরবানী করার সাক্ষ্য প্রদান করেন। হযরত ইবরাহীম (আ) এর সেই মহত্ব ও মাকবুল কুরবানীকে শাশ্বত রূপদানের জন্যেই আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (সা) এই দিনে মুসলমানদেরকে ঈদুল আযহা উপহার দিয়েছেন এবং কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হযরত ইবরাহীম (আ)এর ঈমানের পরীক্ষা ও স্বীয় পুত্র কুরবানীর জীবন্ত ইতিহাস:
মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ) কে মহান আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষা করেছেন। তিনি প্রত্যেকটি পরীক্ষায় পূর্ণ সফলকাম প্রমাণিত হয়েছেন। এর স্বীকৃতি স্বরূপ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তাকে মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে সম্মান ও মর্যাদায় ভুষিত করা হয়েছে।
এক. তাওহীদের হেফাজতের প্রয়োজনে হযরত লূত (আ)কে সাথে নিয়ে চিরদিনের জন্য প্রিয় জন্মভূমি ইরাক ত্যাগ করে ফিলিস্তিনের কেনানে হিজরত করলেন। ৮৬ বৎসর বয়সে সেখানে বসে সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। ‘হে পরওয়ারদিগার!আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দাও’ -(আস সাফফাতঃ ১০০)। এ দোয়ার জবাবে মহান আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম (আ)কে সুসংবাদ দিয়ে বললেন। ‘আমি তাঁকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম’- (আস সাফফাতঃ ১০১)।
দুই. নমরুদ কর্তৃক প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়ে চরম ধৈর্য্য ও আল্লাহর প্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর খলীলের জন্য আগুনকে ফুলবাগীচায় পরিণত করে দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ্ বলেন-‘আমি বললাম, হে আগুন,তুমি ইবরাহীমের উপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও’।
তিন. অতঃপর যখন তাঁর প্রিয় আদরের পুত্র ইসমাঈল ও প্রিয় স্ত্রী হযরত হাজেরা (আ)কে মক্কার বিরাণ মরুভূমিতে রেখে আসার আদেশ হলো সেটাও ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। কেননা বার্ধক্য ও শেষ বয়সের বহু আকাংখার স্বপ্নসাধ, দিবা রাত্রির প্রার্থণার ফল এবং পরিবারের একমাত্র আশার আলো হযরত ইসমাঈল কে শুধু আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পানি ও জনমানবহীন মরু প্রান্তরে রেখে এসেছেন। অথচ একবারও পিছনের দিকে ফিরেও তাকাননি। যেন এমন না হয় যে, পিতৃস্নেহ উথলিয়ে উঠে এবং আল্লাহর আদেশ পালনে কোন প্রকার বিচ্যুতি ঘটে যায়। স্ত্রী ও পুত্রকে সেখানে রেখে এসে তিনি কেবল আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করলেন-‘ হে আমাদের রব! আমি একটি তৃণ পানিহীন উপত্যকায় নিজের বংশধরদের একটি অংশকে তোমার পবিত্র গৃহের কাছে এনে বসবাস করিয়েছি। পরওয়ারদিগার! এটা আমি এ জন্য করেছি যে,এরা এখানে নামাজ কায়েম করবে।কাজেই তুমি লোকদের মনকে এদের প্রতি আকৃষ্ট করো এবং ফলাদি দিয়ে এদের আহারের ব্যবস্থা করো,হয়তো এরা শোকরগুজার হবে’- (আল ইবরাহীমঃ ৩৭)।
চার. উপরোল্লিখিত পরীক্ষাগুলির কঠিন মঞ্জিল অতিক্রম করার পর হযরত ইবরাহীম (আ) কে স্বপ্নের মাধ্যমে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়।যা ছিল বিগত পরীক্ষাগুলির চেয়ে ও অধিক কঠিন, হৃদয় বিদারক ও আল্লাহপ্রেমের কঠিন পরীক্ষা।হযরত ইবরাহীম (আ) স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কুরবানী দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হন।কোন কোন বর্ণনা মতে জানা যায় যে, এই স্বপ্ন হযরত ইবরাহীম (আ) পরপর তিন রাত্রি দেখেছিলেন।প্রথমবার তিনি ১০টি উট কুরবানী করেন। আবারও একই স্বপ্ন দেখলে এবার তিনি ১০০টি উট কুরবানী করলেন।তৃতীয়বার যখন একই স্বপ্ন দেখলেন তখন তিনি বুঝতে পারলেন, আমার কাছে প্রিয় বস্তু একমাত্র কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাইল ছাড়া তো আর কিছুই নেই। মূলত আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাও তাই। প্রাণ প্রিয় পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশ তাঁকে এমন সময় দেয়া হয়েছিল, যখন অনেক দোয়া কামনা করে পাওয়া সন্তানকে লালন পালন করার পর পুত্র পিতার সাথে চলাফেরা করতে পারে এবং তাঁকে সাহায্য করার যোগ্য হয়েছে।
তাফসীরবিদগনের কেউ কেউ লিখেছেন এ সময় হযরত ইসমাঈলের বয়স ছিল তের। কেউ বলেছেন তিনি তখন বয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে তাফসীরে রুহুল বয়ানে আছে ৯ বছরের কথা। এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্য যে, নবী রাসূলগণের স্বপ্নও ওহীর অর্ন্তভূক্ত।তাই এ স্বপ্নের অর্থ ছিল এই যে, আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে হযরত ইবরাহীম (আ) এর একমাত্র পুত্রকে যবেহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ।এ হুকুমটি স্বপ্নের মাধ্যমে দেয়ার কারণ হলো হযরত ইবরাহীম (আ) এর আনুগত্যের বিষয়টি পূর্ণমাত্রায় প্রমাণিত করা।হযরত ইবরাহীম (আ) মহান প্রতিপালকের নির্দেশ সত্বর পালনের নিমিত্তে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন।কিন্তু এ পরীক্ষাটি যেহেতু ইবরাহীম (আ) এর ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে তার পুত্রও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাই তিনি পুত্র ইসমাঈলের সাথে পরামর্শ করার নিমিত্তে তাকে লক্ষ্য করে বললেন-‘হে পুত্র!আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি যবেহ করছি,এখন বল তুমি কি মনে করো?- (আস সা-ফফাতঃ ১০২)
হযরত ইবরাহীম (আ)এর আদর্শের ছাঁচে গড়া পুত্র ইসমাঈল তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পনে মস্তক অবনত করে জবাবে বললেন, ‘হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন,আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহসবরকারীই হিসেবে পাবেন’- (আস সা-ফফাতঃ১০২)।
পরামর্শ শেষে পিতা ও পুত্র মহান আল্লাহরসন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কুরবানীর নির্দেশ পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং এ কাজ সমাধার জন্য তারা মিনা প্রান্তরে গমন করেন। ইতিহাস ও তাফসীর ভিত্তিক কোন কোন রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, শয়তান কুরবানীর মহান এ কাজে বিভিন্নভাবে বাঁধার সৃষ্টি করে ।সে প্রথমে মা হাজেরা ও ইসমাঈল (আ) কে উল্টো বুঝিয়ে এ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে।কিন্তু তাঁরা শয়তানের প্ররোচনাকে কোন পাত্তা দিলেননা।মরদুদ শয়তান হযরত হাজেরা (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ) কে ধোঁকা দেয়া থেকে নিরাশ হয়ে মদিনা যাওয়ার পথে ‘জামরায়ে আকাবাহ’ ‘ জামরায়ে উসত্বা’ এবং ‘জামরায়ে উলা’ এই তিন জায়গায় তিনবার হযরত ইবরাহীম (আ) কে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে এবং হযরত ইবরাহীম (আ) তাকে প্রত্যেকবারই সাতটি করে কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেন।অদ্যবধি এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতি স্বরূপ মিনায় ঐ তিনটি স্থানে কংকর নিক্ষেপ করার বিধান হাজীদের জন্য ওয়াজিব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়ে যখন কুরবানীর উদ্দেশ্যে মিনায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং ইবরাহীম (আ) ইসমাঈল (আ) কে কুরবানী করার জন্য শোয়ালেন, তখন পুত্র ইসমাঈল পিতা ইবরাহীম (আ) কে বললেন আব্বাজান! আমার হাত-পা খুব শক্ত করা বেঁধে নিন যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি।আর আপনার পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলে নিন,যাতে আমরা রক্তের ছিটা তাতে না পড়ে।অন্যথায় এতে আমার ছওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হয়ে যেতে পারেন। আপনার ছুরিটি ভালো করে ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। কারণ, মৃত্যু বড় কঠিন ব্যাপার।আপনি আমার আম্মাজানের নিকট আমার শেষ বিদায়ের সালাম টুকু অনুগ্রহ পূর্বক পৌঁছে দিবেন। যদি আমার জামা তার নিকট নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন। একমাত্র আদরের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কি যে হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু হযরত ইবরাহীম (আ) দৃঢ়তায় অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন,ওগো আমার প্রাণ প্রিয় বৎস! আল্লাহরনির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছ।ইবরাহীম (আ) পুত্রকে আদর করে চুম্বন করলেন এবং অশ্রু সজল নয়নে তাকে বেঁধে নিলেন।
অতঃপর তাঁকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে তার গলায় ছুরি চালালেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার যে, বার বার ছুরি চালানো সত্বেও গলা কাটছে না। কেননা আল্লাহতায়ালা স্বীয় কুদরতে পিতলের একটা টুকরা মাঝখানে অন্তরায় করে দিয়েছিলেন। তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন, আব্বাজান! আমাকে উপুড় করে শুইয়ে নিন।কারণ আমার মুখমন্ডল দেখে আপনার মধ্যে পিতৃস্নেহ উথলে উঠে।ফলে গলা কাটা যাচ্ছেনা।ইবরাহীম(আ) তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন এবং পুনরায় সজোরে প্রাণপনে ছুরি চালালেন। কিন্তু তখনও গলা কাটতেছেনা।হযরত ইবরাহীম (আ)এর এ প্রানান্তকর প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করে মহান আল্লাহসন্তুষ্ট হলেন এবং হযরত ইসমাঈলের বিনা যবেহেই তার কুরবানী কবুল করে নিলেন।মহান আল্লাহবলেন-‘অবশেষে যখন পিতাপুত্র উভয়ে আল্লাহরকাছে নিজেদের আনুগত্যের শির নত করে দিল এবং ইবরাহীম (আ) পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন(যবেহ করার জন্য),তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম,হে ইবরাহীম!তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ।আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি।বস্তুতঃ এ এক কঠিন পরীক্ষা।আর আমরা বিরাট কুরবানী দিয়ে ফিদিয়া স্বরূপ তাকে (ইসমাঈলকে) উদ্ধার করেছি’-(আস সা-ফফাতঃ ১০৩-১০৭)।
অতঃপর মহান আল্লাহনির্দেশ দিলেন এখন পুত্রকে ছেড়ে দিন এবং আপনার নিকট যে দুম্বাটি দাঁড়ানো রয়েছে, পুত্রের পরিবর্তে সেটাকে যবেহ করুন। তখন ইবরাহীম (আ) পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন একটি হৃষ্ট পুষ্ট দুম্বা দাঁড়ানো আছে।আল্লাহরশোকর আদায় করে তিনি সে দুম্বাটিকে যবেহ করলেন।এটাই সেই কুরবানী যা আল্লাহরদরবারে এতই প্রিয় ও মাকবুল হয়েছিল যে, আল্লাহতায়ালা পরবর্তী সকল উম্মতের মধ্যে তা অবিস্মরণীয় রূপে বিরাজমান রাখার ব্যবস্থা করে দিলেন।
যার কারণে মিল্লাতে ইবরাহীমে তথা দ্বীন ইসলামের এক মহান ওয়াজিব ইবাদত হিসেবে এ কুরবানী আজও পালিত হয়ে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা পালিত হতে থাকবে।
আল্লাহু আকবার তাকবীরের প্রেক্ষাপটঃ
মহান আল্লাহরসন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজরত ইবরাহীম (আ) যখন কলিজার টুকরা পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে লাগলেন, তখন হজরত জিব্রাইল (আ) আল্লাহরনির্দেশে বেহেশত থেকে একটা দুম্বা নিয়ে রওয়ানা হলেন।তিনি ভাবলেন, না জানি আমি পৃথিবীতে পৌঁছার আগেই ইবরাহীম (আ) জবাই কাজ শেষ করে দেন!আর এজন্যই জিব্রাইল (আ) আকাশ থেকে উচ্চস্বরে ধ্বনি দিতে থাকেন ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’। এমন মধুর ধ্বনি শুনে হজরত ইবরাহীম (আ) স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’। হজরত ইসমাইল (আ) পিতার মুখে তাওহীদের বাণী শুনতে পেয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’ হজরত জিব্রাইল (আ) এবং দুই নবীর কালামগুলো আল্লাহরকাছে এতই পছন্দনীয় হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতরের দিনগুলোতে বিশ্ব মুসলিমের কণ্ঠে ওই কালামগুলো উচ্চারিত হতে থাকবে।
ঈদুল আযহার গুরুত্ব:
ঈদুল আযহার গুরুত্ব অপরিসীম।কুরআন-হাদীছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তাকীদ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহবলেন-
১. ‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহরনিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’- (হজ্বঃ ৩৬)।
২. ‘আর আমরা তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী। এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম’- (আস সা-ফফাতঃ ১০৭-১০৮)।
৩. ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’- (কাওছারঃ ২)।
৪. রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন,‘কুরবানীর দিনে মানবসন্তানের কোনো নেক আমলই আল্লাহতায়ালার নিকট এত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কুরবানী করা। কুরবানীর পশুর শিং, পশম ও ক্ষুর কিয়ামতের দিন (মানুষের নেক আমলনামায়) এনে দেওয়া হবে। কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহরদরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানী করো’ (তিরমিযী)।
৫. রাসূল (সা)আরো বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’- (ইবনে মাজাহ)।
কাজেই কুরবানী ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীম’ হিসাবে রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কোরান ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।কুরবানী ও জীবন দানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্যে আল্লাহরাব্বুল আলামীন নবী (সা)কে আরো নির্দেশ দিয়ে বলেন-‘বলো,আমার নামায,আমার ইবাদতের সমস্ত অনুষ্ঠান,আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহরাব্বুল আলামীনের জন্য,যার কোন শরীক নেই।এরই নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে এবং সবার আগে আমিই আনুগত্যের শির নতকারী’- (আল আন’আমঃ ১৬২-১৬৩)।
ঈদুল আযহার প্রকৃত তাৎপর্য:
১. ঈদুল আযহা হযরত ইবরাহীম (আঃ), বিবি হাজেরা ও ইসমাঈলের পরম ত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত উৎসব।ত্যাগের পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হবার কারনেই ইবরাহীম (আঃ)কে পবিত্র কুরআনে মুসলিম জাতির পিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে-‘তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও’- (হজ্বঃ৭৮)।এ পরিবারটি বিশ্ব মুসলিমের জন্য ত্যাগের মহত্তম আদর্শ। তাই ঈদুল আযহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতি ইবরাহীমী সুন্নাত পালনের মাধ্যমে আল্লাহরসন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করে।
২. কুরবানী হ’ল চিত্তশুদ্ধির এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হ’লেও আল্লাহরজন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র বিধাতা প্রতিমুহূর্তেই যার করুণা লাভের জন্য মানুষ প্রত্যাশী। আমাদের বিত্ত, সংসার এবং সমাজ তাঁর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত এবং কুরবানী হচ্ছে সেই নিবেদনের একটি প্রতীক।
৩. কুরবানীর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহরজন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে রাযী আছে কিনা সেটিই পরীক্ষার বিষয়। কুরবানী আমাদেরকে সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ইবরাহীম (আ) এর কাছে আল্লাহরপরীক্ষাও ছিল তাই। আমাদেরকে এখন আর পুত্র কুরবানী দেওয়ার মত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হ’তে হয় না। একটি ‘মুসান্নাহ’ হালাল পশু কুরবানী করেই আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে পারি।ঈমানের এসব কঠিন পরীক্ষায় যারা যত বেশি নম্বর অর্জন করতে পারেন তারাই হন তত বড় খোদা-প্রেমিক ও ততই সফল মানুষ এবং আল্লাহরপ্রতিনিধি হিসেবে ততই সফল। ঈদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক আনন্দ তারা ঠিক ততটাই উপভোগ করতে পারেন যতটা তারা এ জাতীয় পরীক্ষায় সফল হন।
৪. কুরবানীর পশুর রক্ত মাটি স্পর্শ করার পূর্বেই আল্লাহরকাছে তার ছওয়াব গ্রাহ্য হয়ে যায়। আল্লাহরকাছে কুরবানীর ছওয়াব গ্রাহ্য হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, যে অকুণ্ঠ ঈমান আর ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে ইবরাহীম (আ) স্বীয় প্রাণাধিক পুত্রের স্কন্ধে ছুরি উত্তোলিত করেছিলেন, কুরবানীর পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার সময়ে কুরবানীদাতার হৃদয়তন্ত্রী সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত হতে হবে।কুরবানীদাতার হৃদয়তন্ত্রী যদি সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত না হয়ে উঠে, তাদের দেহ আর মনের পরতে পরতে যদি আল্লাহরকাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ উদ্বেলিত না হয়, তাহ’লে তাদের এই কুরবানীর উৎসব গোশতখুরীর পর্বেই পর্যবসিত হবে। আল্লাহদ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরবানীদাতাদের সাবধান করে দিয়েছেন, ‘কুরবানীর পশুর গোশতও আল্লাহরকাছে পৌঁছেনা,তাদের রক্তও না।কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া’- (হজ্জঃ ৩৭)।
৫. কুরবানী কেবল পশু কুরবানী নয়।নিজের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহংকার ত্যাগের কুরবানী। নিজের নামায, কুরবানী, জীবন-মরণ ও বিষয়-আশয় সব কিছুই কেবল আল্লাহরনামে, শুধু তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানস এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কুরবানী। এই কুরবানী পশু যবেহ থেকে শুরু করে নিজের পশুত্ব যবেহ বা বিসর্জন এবং আল্লাহরপথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে তার রাস্তায় শাহাদতবরণ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এই কুরবানী মানুষের আকাঙ্ক্ষা, নিয়ত,প্রস্তুতি ও গভীরতম প্রতিশ্রুতি থেকে আরম্ভ করে তার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত।
৬. কুরবানী হচ্ছে মূলতঃ একটি প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহরজন্য বান্দার আত্মত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কুরবানীর থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বছরই আল্লাহরনৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে ত্যাগের মনোভাব গড়ে উঠলে বুঝতে হবে কুরবানী স্বার্থক হয়েছে,কুরবানীর ঈদ স্বার্থক হয়েছে। নতুবা এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল। এজন্য আল্লাহরাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে বারবার ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন।কুরবানির গোশত আল্লাহরকাছে যায় না।যতটুকু যায় বা রেকর্ড হয়ে থাকে তা হল আমাদের মনে খোদা-প্রেমের গভীরতার মাত্রা।কুরবানির গোশত দরিদ্রদের জন্য যতটুকু বিলিয়ে দেয়া হয় কেবল সেটাই পরকালে আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে।আর যেটাকে আমরা আমাদের অংশ মনে করে কৃপণের ধনের মত আঁকড়ে আছি সেটাই বরং আমাদের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে আছে যা আমরা জানি না। আল্লাহবলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছো এবং যা কিছু আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য বের করে দিয়েছি,তা থেকে উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহরপথে ব্যয় করো’-(আল বাক্বারাহঃ ২৬৭)।কাজেই আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানবতার সেবায় ব্যয় করতে হবে। দরিদ্র মানুষের সহযোগিতায় সরকারের পাশাপাশি সকল বিত্তশালী লোককে এগিয়ে আসতে হবে। সারা বছর, সারা জীবন সাধ্যমত আল্লাহরসন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের কথা বিবেচনা করে মানুষকে সাহায্য করতে হবে। চিত্ত আর বিত্তের মিল ঘটানোর জন্যই আল্লাহপবিত্র কুরআনে বারবার মানুষকে আহবান করেছেন।
৭. কুরবানী কোনো লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার উৎসব নয়। কুরবানীতে যদি আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা না থাকে তাহলে এই সুবর্ণ সুযোগ বিফল মনোরথ ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমাদের সমাজে আজ অনেককে বড় বড় পশু ক্রয় করে প্রদর্শন করা কিংবা বাহাদুরি জাহির করতে দেখা যায়। আবার অনেককে দেখা যায় গরিব-মিসকিনদের যথাযথভাবে না দিয়ে ঈদের দিন নিজেরা যৎসামান্য গোশত রান্না করে; আর বাকিটা ফ্রিজে রেখে দেয়।এরপর সারা বছর কিছু কিছু নিয়ে নিজেরা খায়। এসব কোনো মতেই প্রকৃত কুরবানীর পর্যায়ে পড়ে না।লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বড় বড় গরু ক্রয় করে প্রদর্শন করা, বাহাদুরি জাহির করা অথবা গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করলে কুরবানী কবুল হবে না।তা কেবলমাত্র পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।এসব পশুর রক্ত আর গোশত যেমন আল্লাহরনিকট যায় না তেমনি গ্রহণযোগ্যতা পায় না এগুলোর কুরবানীও।হালাল উপার্জন, ইখলাছ ও একনিষ্ঠতাই হলো কুরবানী কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত। কে কত টাকা দিয়ে পশু ক্রয় করল, কার পশুটি কত মোটাতাজা বা সুন্দর, আল্লাহতা দেখেন না।তিনি দেখেন ছহীহ নিয়ত ও তাকওয়া।মূলতঃ আল্লাহররাহে জীবন উৎসর্গ করার জাযবা সৃষ্টি করা, ইবরাহীম (আ) এর পুত্র কুরবানীর ন্যায় ত্যাগ-পূত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আল্লাহরঅনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করাই ঈদুল আযহার প্রকৃত তাৎপর্য।
ঈদুল আযহার চিরায়ত শিক্ষা:
মানুষ মহান আল্লাহরজন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইবরাহীম (আ) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) আমাদের জন্য ঐ ত্যাগের আনুষ্ঠানিক অনুসরণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। ঈদুল আযহার মূল শিক্ষা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরপ্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক হ’তে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহরদিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মুহাববত সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে আল্লাহরসন্তুষ্টি প্রতি আত্মসমর্পিত হয়ে যাওয়া।স্বামী, স্ত্রী ও শিশুপুত্রের গভীর আত্মবিশ্বাস, অতলান্তিক ঈমানী প্রেরণা, আল্লাহরপ্রতি নিশ্চিন্ত নির্ভরতা ও অবশেষে আল্লাহকে খুশী করার জন্য তাঁর হুকুম মোতাবেক জীবনের সর্বাধিক প্রিয় একমাত্র সন্তানকে নিজ হাতে যবেহ করার কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তরণ-এসবই ছিল আল্লাহরপ্রতি অটুট আনুগত্য, গভীর আল্লাহভীতি এবং নিজের তাওহীদ ও তাকওয়ার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহরহুকুমে পুত্র কুরবানী করার মধ্য দিয়ে মূলতঃ পুত্রের মুহাববতকে কুরবানী করেছিলেন।আল্লাহরভালোবাসার চাইতে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছে তাঁর আচরণে।ইবরাহীম (আ)এর নিকট থেকে আল্লাহএটাই চেয়েছিলেন।আর এটাই হ’ল প্রকৃত তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি।
ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রিয়পুত্র ইসমাঈল (আঃ)কে কুরবানী করে এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যাতে অনাগত ভবিষ্যতের অগণিত মানুষ আল্লাহরনিকট আত্মসমর্পণের বাস্তব শিক্ষা লাভ করতে পারে।আর ইসমাঈল নবীন বয়সেই বিশ্ববাসীকে আত্মসমর্পণের এক বাস্তব ও জ্বলন্ত শিক্ষা প্রদান করে গেছেন। মূলতঃ আল্লাহররাহে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার নামই হ’ল আত্মসমর্পণ। পিতা-পুত্র আল্লাহরপ্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা যেমন অতুলনীয়, তেমনি চির অনুকরণীয়। আজকে ইবরাহীমী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পশু কুরবানীর সাথে সাথে আমাদের দৃপ্ত শপথ নিতে হবে যে, আল্লাহরসন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জান, মালসহ যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা প্রস্ত্তত আছি। আর এটিই হ’ল কুরবানীর শিক্ষা। এই স্বর্ণোজ্জ্বল আদর্শ যুগে যুগে বিশ্ববাসীকে বারবার এই পরম সত্যটিকেই হৃদয়ঙ্গম করাতে চেয়েছে যে, আল্লাহই একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, তাঁর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনই প্রকৃত মুমিনের কাজ এবং তাতেই নিহিত রয়েছে অশেষ কল্যাণ ও প্রকৃত সফলতা। ইবরাহীম (আঃ) সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহরসন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন, হয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহঘোষিত মানবজাতির ইমাম। তিনি মানবজাতির আদর্শ। আল্লাহবলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহও পরকালের ভয় কর তোমাদের জন্যে ইবরাহীম ও তাঁর সাথীদের মধ্যে একটি উত্তম আদর্শ বিদ্যমান’- (মুমতাহিনা: ৪)।