পহেলা মে মহান মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। পৃথিবীর শ্রমজীবি মেহনতি মানুষের কাছে এ দিনটি একদিকে যেমন খুবই তাৎপর্যময় তেমনি অনেক বেশী আবেগ ও প্রেরণার দিন। প্রায় দেড়শত বছর আগে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ দুর্বার সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় শ্রমজীবী মানুষের বিজয়ের ধারা। সেই বিজয়ের ধারায় উদ্ভাসিত বর্তমান বিশ্বের সকল প্রান্তের প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষ। কারণ এ দিনটির মাধ্যমে শ্রমজীবি মানুষ তাদের কাজের প্রাথমিক স্বীকৃতি পেয়েছে। পহেলা মে এক দিনের আন্দোলনের ফসল নয় বরং দীর্ঘ সময় ধরে দাবী আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে কিছুটা প্রাপ্তি এবং স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে এই দিনে। তাই ঐতিহাসিক মে দিবস বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষার দিন। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন।
ক্রমাগত অবহেলা ও শোষণ-নিপীড়নের শিকার শ্রমজীবি মানুষঃ
বর্তমান আধুনিক বিশে^র যেখানে যতটুকু সুন্দর তার পেছনে রয়েছে শ্রমজীবি মানুষের হাতের ছোঁয়া, রয়েছে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম। এক কথায় বলা যায় আধুনিক সভ্যতা শ্রমজীবি মানুষ ধরে রেখেছে। তারা স্ব-স্ব অবস্থান থেকে কাজ বন্ধ করে দিলে গোটা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ শ্রমজীবি মানুষদের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবি হলো, তাদের শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ এবং সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বেচে থাকা। কিন্তু পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থা আজও এ মানুষগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়নি।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকের কথা। তখন দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের সীমা ছিল না। মালিকেরা নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দরিদ্র মানুষের শ্রম কিনে নিতেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাড়ভাঙা শ্রম দিয়েও শ্রমিক তার ন্যায্য মূল্য পেতেন না। মালিকেরা উপযুক্ত মজুরি তো দিতেনই না, বরং তারা শ্রমিকের সুবিধা-অসুবিধা ও দুঃখ-কষ্ট পর্যন্ত বুঝতে চাইতেন না। মালিকেরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিককে দাস-দাসীর মতো মনে করতেন এবং তাদের সাথে পশুর মতো ব্যবহার করতেন। সুযোগ পেলেই মালিকেরা শ্রমিকের ওপর চালাতেন নানা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন। বলতে গেলে শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারও তখন রক্ষিত হতো না। শ্রমিকের শরীরের ঘাম আর সীমাহীন শ্রমের বিনিময়ে মালিক অর্জন করতেন সীমাহীন সম্পদ অথচ তার ছিটেফোঁটাও শ্রমিকের ভাগ্যে জুটত না। সপ্তাহে ৬ দিনের প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘন্টার অমানবিক পরিশ্রম করতো কিন্তু তার বিপরীতে মিলত নগন্য মজুরী। যা দিয়ে একজন শ্রমিকের সংসার চলত না, স্বজনের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দেয়া সম্ভব হতো না। পরিবার-পরিজন নিয়ে শ্রমিকের জীবন ছিল দুর্বিষহ। অনিরাপদ পরিবেশে রোগ-ব্যাধি, আঘাত, মৃত্যুই ছিল তাদের নির্মম সাথী। একদিকে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও দাবি দাওয়ার কথা মন খুলে মালিকদের বলতে পারতো না অপরদিকে তাদের পক্ষ হয়ে বলার মতও কেউ ছিলনা। কাজের যেমন সুনির্দিষ্ট সময় ছিল না, তেমনি ছিল না সাপ্তাহিক ও অন্যান্য ছুটি। চাকুরীর স্থায়িত্ব ও মজুরিসহ সকল বিষয় ছিল মালিকের ইচ্ছাধীন বিষয়। চরম বিপদের দিনেও শ্রমিকরা ছুটি পেতনা। দায়িত্বপালন কালে দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু ঘটলে তার পরিবারকে কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হতো না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিন-রাতে প্রায়ই ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতো তারা। শ্রমিকরা তাদের দাবি দাওয়ার কথা বললে মালিকরা তাদের ওপর ক্ষেপে যেতো, এমনকি মালিকদের ভাড়াটে মাস্তানরা তাদের ওপর জুলুম করতো। মালিকরা শ্রমিকদের কলুর বলদের মতো খাটাতো। তাদের ওপর অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দিতো। এতে শোষণ-নিপীড়ন ও বঞ্চনাই শ্রমিকের পাওনা হয়ে দাঁড়ায়।
ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’ নামক বিখ্যাত বইতে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস শ্রমিক শ্রেণীর নিদারুণ দারিদ্রের চিত্র তুলে ধরে লিখেছেন যে, “প্রতিটি বৃহৎ শহরেই ছিল এক বা একাধিক বস্তি, যেখানে শ্রমিকরা ঠাসাঠাসি করে বাস করতো। এটা সত্যি যে, ধনীদের প্রাসাদের নীচে অন্ধকারের আনাচে-কানাচে প্রায়ই থাকে দরিদ্রের অবস্থান, কিন্তু দরিদ্রের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে এখানে একটা পৃথক অঞ্চল, যাতে করে ধনিক শ্রেণীর দৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করে দরিদ্র মানুষ তার সাধ্যমত জীবন সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে পারে।
“পুঁজিবাদী শোষণের বর্বরতা প্রসঙ্গে ওই বইতে বলা হয়েছে যে, “শিল্প মালিকদের ঘৃণ্য অর্থ লালসা জন্ম দিল বহু সংখ্যক ব্যাধির। স্ত্রী লোকেরা সন্তান ধারণে অনুপযুক্ত হলো, শিশুদের অঙ্গ বিকৃতি ঘটলো, পুরুষরা দুর্বল হলো, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ভেঙেচুরে গেলো। একটা সমগ্র প্রজন্মই ব্যাধিতে এবং দৈহিক অক্ষমতায় সর্বনাশপ্রাপ্ত হলো এবং তার একমাত্র কারণ হলো বুর্জোয়াদের অর্থের ঝুলিটিকে ফাঁপিয়ে তোলা।”
পুঁজিবাদী নির্যাতনের নৃশংসতা প্রসঙ্গে এই বইতে আরো বলা হয়েছে, “কিভাবে সর্দাররা নগ্ন শিশুগুলোকে তাদের শয্যা থেকে ধরে আনে এবং লাথি ঘুষি মারতে মারতে তাদের কারখানায় ঠেলে নিয়ে যায়। শিশুদের জামা কাপড়গুলো তাদের হাতেই থাকে আর কিভাবে ঘুষি মেরে তাদের ঘুম ছাড়িয়ে দেওয়া হয়, কিভাবে তা সত্তে¡ও শিশুগুলো কাজ করতে করতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে এবং আবার কিভাবে সর্দারের ডাকে একটি অসহায় ঘুমন্ত শিশু ধড়মড় করে জেগে ওঠে…কিভাবে অতি ক্লান্ত শিশুগুলো শুকনো কারখানা ঘরে পশমের মধ্যে লুকিয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়ে এবং আবার কিভাবে চাবুক খেয়ে কারখানা থেকে বিতাড়িত হয়, কিভাবে শত শত শিশু রাতে এত ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যে, নিদ্রালুতার জন্য এবং খিদে বিনষ্ট হওয়ায় রাতের খাবার খেতে পারে না।”
একদিকে পুঁজিপতি শ্রেণীর সমৃদ্ধি, বিলাস ও চাকচিক্য এবং অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণীর নিদারুণ দারিদ্র ও তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতনের বাস্তবতায় শুরু থেকেই এই দুই শ্রেণীকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তাই একই সাথে জন্ম নেওয়া এবং একই সাথে থাকতে বাধ্য হওয়া দুই শ্রেণীর মধ্যে লড়াই-সংগ্রাম জন্মালগ্ন থেকেই চলতে থাকে।
অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শ্রমজীবি মানুষের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকাঃ
ক্রমাগত অবহেলা এবং মালিকদের সীমাহীন অনাচার, অর্থলিপ্সা ও একপাক্ষিক নীতির ফলে শ্রমিকদের মনে ক্রমেই জমতে শুরু করে প্রচন্ড ক্ষোভ ও দ্রোহ। আন্দোলনের গোড়ার দিকে এধরনের শোষণ, নির্যাতন ও নীপিড়ন কিভাবে প্রতিরোধ করতে হবে শ্রমিকরা তা জানতোনা। এই অমানবিক পশুসুলভ অবস্থা থেকে শ্রমিকরা মুক্তি পেতে চাইতো। কল-কারখানার কাজ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারবে বলে তারা ভাবতে পারতো না। মেশিনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হতো বলে দম ফেলার সময়টুকুও মিলতোনা। ফলে শ্রমিক শ্রেণীর কাছে সেই সময়ে পুঁজিপতি শ্রেণী নয়, যন্ত্রদানবই ছিল প্রধান শক্র। এর ফলে ১৭৬০ এর দশক থেকে শ্রমিকের রূপকথার রাজা হিসাবে ইতিহাসে উল্লেখিত এক শ্রমিক নেড লুড এর নেতৃত্বে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে মেশিন ভাঙ্গার, কারখানা বাড়িতে আগুন দেয়ার আন্দোলন শুরু করে। ‘নেড লুড’ এর নাম অনুসারে এ আন্দোলনের নাম হয়েছে লুডাইট আন্দোলন। কিছুদিনের মধ্যে এ আন্দোলন সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩০ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন প্রাধান্য বিস্তার করে রাখে।
লুডাইট আন্দোলন চলার সময়ে ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণী শুরু করেছিলো ধর্মঘট আন্দোলন। কিছুকালের মধ্যে ইউরোপের কিছু দেশ ও আমেরিকায় ধর্মঘট আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণীর দাবী আদায়ের সবচেয়ে ব্যাপক ও কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়। এসব স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠতে থাকে এবং সংগঠিত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। প্রথম দিকে শ্রমিকরা প্রাথমিক ধরনের ক্লাব বা ইউনিয়নে সংগঠিত হয়। শ্রমিকরা তাদের স্বল্প আয় থেকে সামান্য অর্থ বাঁচিয়ে ছোট ছোট সমবায় অর্থভাÐার গড়ে তোলে। এসব ক্লাবের সদস্য হবার জন্য চাঁদা এবং পরবর্তী সাপ্তাহিক বা মাসিক চাঁদা একটি বিশেষ বাক্সে জমা রাখা হতো। এ কারণে এধরণের ক্লাব ‘বক্স ক্লাব’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে।
এসব বক্স ক্লাবের অর্থভাÐার থেকে অসুস্থ ও ছাঁটাই হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের প্রয়োজনে অর্থ সাহায্য দেওয়া হতো। তারপর কোনো শ্রমিক বা তার পরিবারের অন্য কোনো সদস্য অসুস্থ বা মৃত্যু মুখে পতিত হলেও এ অর্থভাÐার থেকে অর্থ দেওয়ার নিয়ম চালু হয়। এই ইউনিয়ন বা ক্লাবগুলোকে অর্থনৈতিক লেনদেন করতে হতো বলে সাধারণত প্রথম দিকে এতে কেবল কোষাধ্যক্ষ নির্বাচন করার নিয়ম ছিল। কোষাধ্যক্ষই এসব ক্লাবের প্রধান হতেন, প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারী বলে কোনো পদ ছিলো না। ১৭৭০-এর দশকে স্বত:স্ফুর্তভাবে ইংল্যান্ডে এধরনের ক্লাব গড়ে উঠতে দেখা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংল্যান্ডেজুড়ে এ ধরনের কয়েক হাজার ক্লাব গড়ে ওঠে।
স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের ক্লাবগুলোর কাজ কেবল সমবায় অর্থভাÐারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। ক্রমেই এগুলো মজুরি, কর্মদিন সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মালিকদের সাথে দেন-দরবারে জড়িত হয়ে পড়লো। এছাড়া ধর্মঘটী শ্রমিকদের অর্থ সাহায্যের জন্যও এ ক্লাবগুলো এগিয়ে এলো। শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তাদের শ্রেণী চেতনা বাড়ছে দেখে এ ধরনের ক্লাবগুলোকে পুঁজিপতি শ্রেণী সহ্য করলো না। সমবায়ের অর্থ কেড়ে নিয়ে এগুলোকে অকেজো করে দেওয়া হলো। ‘বক্স ক্লাব’ এর সীমাবদ্ধ কাজ ছাড়া অন্যান্য কর্মকাÐে অংশগ্রহণ করতে হলে রেজিষ্ট্রেশন নেওয়ার জন্য ১৭৯৩ সালে ইংল্যান্ডে আইন পাস হয়।
১৭৯০ সালের পর থেকেই পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনার জন্য শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলে। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন শুরু থকেই ব্যাপক ও তীব্র হয়ে উঠে। ফলে ১৭৯৯-১৮০০ সালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন পাস করে। তখন ইংল্যান্ডের শ্রমিকরা গোপন ও আধা গোপনে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন এবং জনমতের চাপে ১৮২৪ সালে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
অধিকার আদায়ের ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৮৩০ সনে শ্রমিকরা গঠন করে ‘ন্যাশনাল আ্যাসোসিয়েশন ফর দি প্রটেকশন অব লেবার’ (ঘধঃরড়হধষ অংংড়পরধঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ ড়ভ খধনড়ঁৎ)। এর তিন বছর পর গঠিত হয় এৎধহফ ঘধঃরড়হধষ ঈড়হংড়ষরফধঃবফ ঞৎধফব টহরড়হ নামে এক সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ লাখ।
ইউরোপের অন্যান্য দেশেও পুঁজিপতি শ্রেণী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন অষ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য নানা ধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
ফ্রান্সে শ্রমিকদের ধর্মঘট আন্দোলন শুরু হবার সাথে সাথেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে থাকে। ১৭৯১ সালে নিষিদ্ধ করে এক আইন পাস করা হয়। ১৮৩০ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে এবং ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে নানা ধরনের আইন জারি করে প্রকৃতপক্ষে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন অকেজো করে রাখার চেষ্টা হয়। দমননীতি সত্তে¡ও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক ইউরোপ ও আমেরিকায় ধর্মঘট আন্দোলনের ব্যাপ্তি ঘটে।
শ্রমিক শ্রেণী সর্বপ্রথম ফ্রান্সে রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রভাবে রাজনৈতিক সংগ্রামে অবর্তীন হয়। ফ্রান্সের লিয়নস শহরের তাঁত শ্রমিকরা টানা তিন বছর রাজনৈতিক লড়াই চালায়। অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকরাও তাঁতীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৮৩১ সালের নভেম্বর মাসে লকআউট ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণী আওয়াজ তোলে, ‘কাজ করে বাঁচতে দাও, নতুবা যুদ্ধ করে মরতে দাও।’ এই লড়াই তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করলে সরকারি সৈন্যবাহিনীর সাথে শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ লড়াই হয়। শ্রমিকরা শহরের ক্ষমতা দখল করে নেয়। কিন্তু এই সংগ্রামের কোনো সুষ্পষ্ট লক্ষ্য ছিল না। কারখানা মালিকদের প্রতি চরম ঘৃণাই ছিল এই সংগ্রামের মূল প্রেরণা। ১৫ দিন সুশৃংখল ও নির্ভীকভাবে শহর দখলে রাখার পর প্রচÐ আক্রমণের মুখে এই অভ্যুত্থান পরাজয় বরণ করে। কিছু দিনের মধ্যেই ১৮৩৪ সালের ৯ এপ্রিল আবার সংগ্রাম শুরু হয়। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ও সভা-সমাবেশ বেআইনি করার আইন পাসের চেষ্টা এবং শ্রমিক ধর্মঘটের সংগঠকদের অন্যায় বিচারের প্রতিবাদে এই সংগ্রাম প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক রূপ নেয়। ‘স্বাধীনতা, সমতা, সৌভ্রাতৃত্ব নতুবা মৃত্যু’ এই শ্লোগান সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহবান জানানো হয়। সরকারী বাহিনীর সশস্ত্র হামলা মোকাবিলা করার জন্য আন্দোলনকারী শ্রমিকরাও অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখল করে রাখে। লাল ব্যানারে ¯েøাগান লেখা হয়, ‘বুর্জোয়াদের হটাও, প্রজাতন্ত্র কায়েম নতুবা মৃত্যু।’ ৭ দিন বীরত্বপূর্ন ও সাহসী লড়াই চালানোর পর শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সেনাবাহিনীর কাছে লিয়নস শহরের সশস্ত্র অভ্যুত্থান দ্বিতীয় বারের মতো পরাজয় বরণ করে। লিয়নস শহরের সশস্ত্র অভ্যুত্থান খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। কিন্তু ইংরেজ শ্রমিকদের প্রথম স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চলে। এই আন্দোলন ‘চার্টিস্ট আন্দোলন’ বলে পরিচিত। এই আন্দোলন ১৮৩৬ সালে থেকে শুরু হয়ে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে অনেক দিন পর্যন্ত এই আন্দোলনের রেশ ছিল। চার্টিস্ট আন্দোলন রাজনৈতিক দাবিতে ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনকে সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম গণআন্দোলন বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।
১৮৩৬ সালে লন্ডনের দক্ষ কারিগরেরা ‘লন্ডন শ্রমজীবি মানুষের সমিতি’ নামে একটি রাজনৈতিক গ্রæপ গঠন করে। র্যাাডিকেল চিন্তাধারার ব্যক্তিরা এই সমিতিটি প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৩৭-৩৮ সালে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্য থেকে দুটি প্রাথমিক ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়। এই সংগঠন দুটো র্যাডিকেল বুর্জোয়াদের উত্থাপিত উপরোক্ত দাবিনামা নিয়ে আন্দোলনে নামে। ইংরেজিতে ‘দাবিনামা’ শব্দকে ‘চার্টার অব ডিমান্ড’ বলে। সেই থেকে এই আন্দোলন চার্টিস্ট আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৮৪০ সালের জুলাই মাসে উপরোক্ত দাবিগুলোর ভিত্তিতে আন্দোলনকে অগ্রসর করে নেওয়ার জন্য এক সভায় শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম গণভিত্তি সম্পন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ‘জাতীয় চার্টার সমিতি’ গঠিত হয়।
১৮৪২ সালে এই আন্দোলন ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। দাবিনামার ভিত্তিতে পার্লামেন্টের কাছে পেশ করা জাতীয় দরখাস্তে ৩৩ লাখেরও বেশী স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। ২ মে তারিখে দরখাস্ত পার্লামেন্টের কাছে জমা দিতে যাওয়ার মিছিলে ৫ লাখ শ্রমজীবি মানুষ জমায়েত হয়। আগষ্ট মাসে শ্রমিকদের ধর্মঘট আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। কোনো কোনো কল-কারখানায় ও শহরে পরিস্থিতি সম্পূর্নভাবে শ্রমিক শ্রেনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তা সত্তে¡ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলনের অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হয়। সরকার কঠোর হাতে ধর্মঘটী চার্টিস্টদের দমন করে। ফলে এই আন্দোলন পরাজয় বরণ করে। তবে এ আন্দোলনের ফলেই বৃটিশ শ্রমিকরা ১৮৪৭ সালে ১০ ঘণ্টা কর্ম দিবসের দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের ইতিহাসে এই দাবি আদায় এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেননা এই দাবি আদায়ের মাধ্যমেই শ্রমিক শ্রেণী ইতিহাসে সর্বপ্রথম সরকারের কাছ থেকে ন্যায্য দাবি আদায় করে নিতে পেরেছিল।
১৬৮৪ সালের দিকে নিউইয়র্কে সর্বপ্রথম ঠেলাওয়ালাদের ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। ১৭৬৩ সালে চার্লসটনে চিমনি পরিস্কারক শ্রমিকরা একত্র হয়ে দাবি-দাওয়া না মানা পর্যন্ত কাজ করবে না বলে ঘোষণা দেয়। ১৭৭০ সালে নিউইয়র্কে পিপা প্রস্তুতকারক শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। ১৭৭৮ সালে নিউইয়ার্কের ছাপাখানার ঠিকা শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে একত্র হয়। ১৭৮৬ সালে ফিলাডেলফিয়ার ছাপাখানার ঠিকা শ্রমিকরা সর্বপ্রথম তীব্র ধর্মঘট আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায় এবং দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়।
১৮২৩ সালে আমেরিকার ইতিহাসে সর্বপ্রথম মহিলা শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে সাধারণ ধর্মঘটে যোগ দেয়। এই মহিলা শ্রমিকরা ছিল নিউইয়র্কের দর্জি শ্রমিক। ১৮২৮ সালে সর্বপ্রথম শিল্প ও কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘট আন্দোলন শুরু করে। এই ধর্মঘট আন্দোলন ছিল পোশাক কারখানার শ্রমিকদের। ১৮৩৩ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত মজুরি বৃদ্ধি ও ১০ ঘন্টা শ্রম দিবসের দাবিতে ধর্মঘট আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এই ৪ বছরে ১৬৮ টি ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনের ফলে শ্রমিকরা কোথাও কোথাও ১০ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবী আদায় করে নেয়। এই সময়ে সারা দেশে ১৫০ টি শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে ওঠে এবং সভ্য সংখ্যা ৩ লাখে পৌঁছে। আমেরিকাতেই ১৮২৭ সালে ফিলাডেলফিয়ার মেকানিকদের ১৫ টি শ্রমিক ইউনিয়নের সমন্বয়ে সর্বপ্রথম ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন গড়ে ওঠে। ১৮৩৪ সালে জাতীয় ভিত্তিতে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে ‘জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন’ গঠিত হয়। এ সংগঠনটি কাজের সময় কমানোর দাবি জোরের সাথে উত্থাপন করে এবং এ দাবির সমর্থনে জনমত ও আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ৩ বছর কাজ করার পর সংগঠটির বিলুপ্তি ঘটে।
১৮৪২ সালে আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণীর ট্রেড ইউনিয়ন ও ধর্মঘট করার আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮৪৭ সাল থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ১০ ঘণ্টা শ্রম দিবস আমেরিকার সকল রাজ্যে আইনগত স্বীকৃতি পায়।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ঠিক পূর্বে মূহূর্তে ১৮৬১-৬২ সালে জাতীয় ভিত্তিতে কয়েকটি শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে ঢালাই শ্রমিক, মেশিন নির্মাতা শ্রমিক ও কর্মকারদের ইউনিয়নগুলোই ছিল প্রধান। গৃহযুদ্ধের সময়ে জাতীয় ভিত্তিতে গঠিত এই ইউনিয়নগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নারী শ্রমিকরা একত্র হয়ে নারী শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে। নারী শ্রমিকদের ওপর বাড়তি শোষণ ও নির্যাতনের ফলেই তারা স্বতন্ত্রভাবে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ৮ মার্চ দিনটিই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে।
গৃহযুদ্ধ শেষ হবার ঠিক পরেই কয়েকটি স্থানীয় শ্রমিক সংগঠন জাতীয় পর্যায়ে মিলিত হয়ে একটি ফেডারেশন গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করে। ১৮৬৬ সালের ২২ আগষ্ট ৬০ টি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের ৬০ হাজার সংগঠিত শ্রমিক প্রতিনিধিকে নিয়ে বালটিমোর শহরে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’ নামে একটি ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। লোহা ঢালাই শ্রমিকদের তরুণ নেতা উইলিয়াম এইচ, সিলভিস জাতীয় ভিত্তিতে এই সংগঠনটি গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি এ সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’ সংগঠনই সর্বপ্রথম আমেরিকাতে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি উত্থাপন এবং দাবির সমর্থনে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তাব ও উদ্যোগ গ্রহণ করে। ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন প্রস্তাবটি গ্রহণ করার ১ মাস পর ১৮৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম আন্তর্জাতিকের জেনেভা কংগ্রেসে এই দাবির সমর্থনে প্রস্তাব পাস করা হয়।
ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন প্রচার ও আন্দোলনের ফলে আমেরিকার বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল ‘৮ ঘণ্টা শ্রম সমিতি’ স্থাপিত হয়। এই আন্দোলন ব্যাপক ও তীব্র হলে আমেরিকার অনেক রাজ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দিনে ৮ ঘন্টা কাজের দাবি মেনে নেওয়া হয়। ১৮৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা এই মর্মে একটি আইন পাস করে। কিন্তু ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়নের নেতৃত্বে আন্দোলন দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। কেননা ১৮৬৯ সালের দিকে আমেরিকার শ্রমিকদের প্রিয় নেতা সিলভিস ৪১ বছর বয়সে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। এর কিছুদিন পরেই সংগঠনটি লোপ পায়।
১৮৭০ এর দশকে আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে কয়েকটি হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। ১৮৭৪ সালে নিউইয়র্কের টমকিন স্কোয়ারে এক শ্রমিক জনসভায় পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ১৮৭৫ সালে পেনসিলভানিয়া অঞ্চলের কয়লা খনি মালিকরা খনি অঞ্চল থেকে জোর করে খনি শ্রমিকদের সংগঠন উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে। এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে শ্রমিকরা রুখে দাঁড়ায়। আন্দোলনকারী ১০ জন খনি শ্রমিককে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়। এ ঘটনার পটভূমিতে ১৮৭৭ সালে রেল ও ইস্পাত কর্পোরেশনের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ধর্মঘট সংগ্রাম সংঘটিত হয়। কর্তৃপক্ষ ধর্মঘট আন্দোলনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নামায়। ধর্মঘটী শ্রমিকরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই চালায়। এই সংগ্রাম প্রচÐ দমননীতি ও আক্রমণের মুখে পরাজয় বরণ করে। কিন্তু এসব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবির আন্দোলন এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’ নামে একটি সংগঠন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর ওই সংগঠনের চতুর্থ সম্মেলনে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সংগঠিত ট্রেড ও লেবার ইউনিয়নের ফেডারেশন এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে যে, ১৮৮৬ সালের ১ মে তারিখ থেকে দৈনিক ৮ ঘণ্টাকেই কাজের দিন বলে আইনত গণ্য করা হবে। এই সাথে আমরা সকল শ্রমিক সংগঠনের কাছে সুপারিশ করছি যে, তারা যেন উপরোক্ত তারিখের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের সাথে খাপ খাইয়ে নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলন পরিচালনা করে।”
প্রস্তাবটি গ্রহণ করার পর ফেডারেশন বুঝতে পারলো যে, সকল শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া লড়াইয়ে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। তাই তারা অপর একটি সংগঠন ‘নাইটস অব লেবার’কে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান। নাইটস অব লেবার সংগঠনটি আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবারের চাইতে অনেক বড় সংগঠন ছিল। পরবর্তী সময়ে এ সংগঠনটি ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে ধর্মঘট আন্দোলনের বিরোধিতা করে। ফলে শ্রমিকদের কাছ থেকে এই সংগঠনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী যখন জাতীয় ভিত্তিতে একটি মাত্র ¯েøাগান সংগঠিত হচ্ছে; তখন আমেরিকার নানা অঞ্চলে, কল-কারখানায় ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে ধর্মঘট আন্দোলন ব্যাপক ও তীব্র আকার ধারণ করে। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৫০০ ধর্মঘট ও তালাবদ্ধ আন্দোলন হয়। এগুলোতে গড়ে দেড় লাখ শ্রমিক যোগ দেয়।
এসব ধর্মঘটের মূল ¯েøাগান ছিল ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস। ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ঘণ্টা বিনোদন-এভাবে ২৪ ঘণ্টাকে সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া হয়। ক্রমেই এই যুক্তিসংগত ও মানবিক দাবি অসম্ভব রকমের জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কোনো কোনো কারখানার শ্রমিকরা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়।
যে সব জুতা কারখানায় ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায় হয়ে গেছে, শ্রমিকরা সেসব জুতার নাম দিল ‘৮ ঘন্টা জুতা’। সিগারেট কারখানায় দাবি মেনে নিলে তার নাম হলো ‘৮ ঘণ্টা চুরুট’ ইত্যাদি। এভাবে সর্বত্র ‘৮ ঘণ্টার উন্মাদনা’ সারা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে।
মহান মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ইতিহাসঃ
১৮৮৬ সালের ১ মে ছিল শনিবার, স্বাভাবিক কাজের দিন। তা সত্তে¡ও ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস আইনত চালু করার দাবিতে আমেরিকার সকল শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘট অনুষ্টিত হয়। ১ মে’র কিছু দিন আগে ‘নাইটস অব লেবার’ সংগঠনটি ধর্মঘট বানচাল করতে চাইলেও সাধারণভাবে সকল শ্রমিক এ ধর্মঘট আন্দোলনে সরাসরিভাবে অংশ গ্রহণ করে।
এ ধর্মঘট আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল শিকাগো। শিকাগোর শিল্পাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোতে বামপন্থীদের প্রভাব ছিল। এ কারণে শিকাগোতে ধর্মঘট খুবই জঙ্গিরূপ ধারণ করে। ১ মে’র অনেকদিন আগে থেকেই শিকাগোর শ্রমিকরা এ ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেখানে সকল শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে ‘৮ ঘণ্টা শ্রম সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ৮ ঘণ্টা শ্রম সমিতি ধর্মঘটের প্রস্তুতিমূলক কাজ ছাড়াও প্রত্যেক ইউনিয়নকে অর্থ সংগ্রহ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। কেননা ধর্মঘট করার ফলে অনেক শ্রমিকই কর্মচ্যুত হতে পারে, এ ধারণা আগে থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে এই শ্রম সমিতিগুলো ছিল শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ মোর্চার প্রতীক। ফেডারেশন অব লেবার, নাইটস অব লেবার এবং আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম স্বতন্ত্র ও সংগঠিত সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ‘স্যোশ্যালিস্ট লেবার পার্টি’ প্রভৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমিতি গড়ে তুলেছিল। তাছাড়া তখন আমেরিকাতে সকল বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের সমবায়ে ‘সেন্টাল লেবার ইউনিয়ন’ নামে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল। এ সংগঠনটিও ৮ ঘণ্টা শ্রম সমিতিকে সমর্থন জানান। সেন্ট্রাল লেবার ইউনিয়ন ১ মে তারিখের আগের রবিবার ১ মে ধর্মঘট সফল করার জন্য শিকাগো শহরে একটি শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশে ২৫ হাজার শ্রমিক যোগ দেন।
১ মে শিকাগোর শ্রমিক অঞ্চলগুলোতে ধর্মঘট সার্বিকভাবে সফল হয়। শিকাগোকে কেন্দ্র করে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখে। সকাল থেকেই শ্রমিকরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মিশিগান অ্যাভিনিউর মিছিলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। শিকাগোর পুঁজিপতি -মালিকরা এবং কর্তৃপক্ষ এতে আতষ্কিত হয়ে পড়ে। দমনমূলক নীতি চালিয়ে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তথাকথিত নাগরিক কমিটি সারাদিন ধরে সভা চালায়। এ কমিটির নির্দেশে শান্তি ও শৃংখলা রক্ষার অজুহাতে শহরের অলিগলি ও বিশেষ বিশেষ বাড়ির ছাদে পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনী জড়ো করা হয়।
এসব উস্কানির মুখে শিকাগোর শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট ও মিছিল করার চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে। সব কিছু উপেক্ষা করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মিশিগান অ্যাভিনিউর চত্বরে জমায়েত হয়। গগণবিদারী ¯েøাগানে মুখরিত হয়ে মিছিল লেক ফ্রান্টে গিয়ে শেষ হলে শ্রমিক নেতারা সেখানে বক্তৃতা করেন। ইংরেজ, জার্মান, পোলিস প্রভৃতি ভাষায় নেতারা বক্তৃতা দেন এবং শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য সংহতি বজায় রেখে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করা হয়।
শান্তিপূর্ণভাবে ও সাফল্যের সাথে ১ মে’র কর্মসূচী পালন শ্রমিক শ্রেণীকে সংগ্রামের নব প্রেরণায় উজ্জীবিত করে। শিকাগো অঞ্চলের এক লাখ পঁচাশি হাজার শ্রমিক বিশেষ করে রাজমিস্ত্রিরা ৮ ঘণ্টা কাজের দিনের দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়।
একদিকে পুঁজিপতি ও সরকার নাইটস অব লেবার সংগঠনটির সুবিধাবাদী নেতাদের দিয়ে শ্রমিক ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে আন্দোলনকে বানচাল করার চক্রান্ত করে; অন্যদিকে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু তা সত্তে¡ও শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখে।
৪ মে মঙ্গলবার হে মার্কেট স্কোয়ারে এক বিরাট শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের কাছেই কর্তৃপক্ষ প্রচুর সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করে। শ্রমিক নেতা স্পাইজ বক্তৃতা করার পর পার্সনস রাত দশটা পর্যন্ত দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। শেষ বক্তা সাম ফিলডেন বক্তৃতা শেষ করেছেন, শ্রমিক জনতা সভা থেকে উঠে যাচ্ছেন, ঠিক এমনি সময়ে ওয়ার্ড নামে এক ক্যাপ্টেন বক্তৃতা মঞ্চের সামনে এসে নির্দেশ দিনেল, ‘ইলিনয় রাজ্যের জনগণের নামে আমি অবিলম্বে ও শন্তিপূর্নভাবে এই সভা বন্ধ করর নির্দেশ দিচ্ছি।’ শ্রমিক নেতা ফিলডেন ‘আমরা তো শান্তিপূর্ণভাবেই আছি’ দৃঢ়ভাবে কথাটি শেষ করতে না করতেই একটি বোমার বিকট আওয়াজে আকাশ-বাতাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আন্দোলনকে সাবোটাজ করার উদ্দেশ্যে অজ্ঞাত বেশে পুলিশের এক এজেন্ট বোমাটি নিক্ষেপ করে। বোমাটি বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথেই সুযোগের অপেক্ষায় অবস্থানরত সশস্ত্র বাহিনী শ্রমিক-জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বাচারে লাঠি ও গুলি চালানো হয়। ঘটনাস্থলে ৪ জনসহ মোট ১১ শ্রমিক নিহত ও বহু সংখ্যক আহত হন। এ ঘটনায় ৭ পুলিশ নিহত হয়। হে মার্কেটের চত্বর রক্তের বন্যায় প্লাবিত হয়ে যায়।
ইতিহাসে এ ঘটনা ‘হে মার্কেটের ঘটনা’ বলে পরিচিত। এ ঘটনাই মে দিবসের ঐতিহাসিক ঘটনা-যা আজও সমগ্র দুনিয়ার শ্রমিক, শ্রমজীবি ও গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল জনগণকে আন্তর্জাতিক সংহতি ও ভ্রাতৃত্ব বোধে একত্র করে।
হে মার্কেটের রক্তক্ষয়ী ঘটনার সময়েই ঘটনাস্থল থেকে স্পাইজ ও ফিলডেন গ্রেপ্তার হন। কিন্তু অন্যান্য নেতা আত্মগোপনে চলে যান। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পুঁজিপতি শ্রেণী ও সরকার সার্বিক জেহাদ ঘোষণা করে। পত্র পত্রিকায় শ্রমিক নেতা ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কুৎসা, ঘৃণা ও ক্রোধের বন্যা বয়ে যায়। প্রচার চলতে থাকে, ‘তিন দিনের জন্য সভ্যতাকে বিদায় দিয়ে একটি প্রহরী কমিটি নিজেদের হাতেই আইন তুলে নেবে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে। শ্রমিক এলাকাগুলোতে অমানুষিক অত্যাচার ও সন্ত্রাস চলে এবং শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তারের জন্য সরকারী মহল হন্যে হয়ে ওঠে। পত্রিকাগুলোতে আত্মগোপনকারী নেতাদের গ্রেপ্তার করা ও ফাঁসি দেওয়ার কথা জোরেশোরে প্রচার চালানো হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই মাইকেল স্কোয়াব,জর্জ এঞ্জেল, অ্যাডলফ ফিসার, লুই লিংগ ও আস্কার নিবে-এই পাঁচ শ্রমিক নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
শ্রমিক নেতাদের বিচারের নামে প্রহসন:
অভিযুক্ত শ্রমিক নেতাদের বিচার শুরু হয় ২১ জুন। প্রকৃতপক্ষে বিচারের নামে সেটা ছিল প্রহসন। বিচারের জন্য যাদের জুরি নির্বাচিত করা হয়, তারা সবাই আগেই অভিযুক্ত শ্রমিক নেতাদের অপরাধী বলে প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজ সহ ৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৮৮৬ সালের ৯ অক্টোবর বিচারের রায়ে তাদের মৃত্যুদন্ড-দেয়া হলো। কিন্তু এ রায় মেনে নিতে পারেননি শ্রমিক নেতাদের পরিবার। তারা রায়ের প্রতিবাদ করলেন, সমাবেশ করলেন, মিছিল, বক্তৃতা দিলেন। দেশ-বিদেশের সরকারের কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু তাদের প্রতিবাদ কোনো কাজে এলো না এবং শ্রমিক নেতাদের মৃত্যুদন্ড মওকুফ হলো না, বরং আবেদন অগৃহীত হয়ে ফাঁসির রায় অব্যাহত রইল। শ্রমিক নেতাদের দেখার জন্য তাদের পরিবারের সদস্যদেরও কোনো সুযোগ দেয়া হলো না। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুই লিং একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন, অন্য একজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে”। ২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আট জনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং রায়ের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায়নি।
মে দিবস পালনের ঘোষণাঃ
শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের “দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার” দাবী অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায়। শ্রমিক নেতাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে মে দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের উক্ত গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণ করে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১লা মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে “মে দিবস” বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস”। ১৮৯০ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট কংগ্রেসে’ ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয় এবং তখন থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিক শ্রেনী কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে। রাশিয়াসহ পরবর্তীকালে আরো কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। জাতিসংঘে একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শাখা হিসাবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আই.ত্রল.ও প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার সমূহ স্বীকৃতি লাভ করে এবং সকল দেশে শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের তা মেনে চলার আহবান জানায়।
বাংলাদেশে মে দিবস পালন এবং শ্রমিকদের বাস্তবতাঃ
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং আই.এল.ও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। এই দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা অনেক। শ্রমিক দিবসের প্রেরণা থেকে বাংলাদেশ মোটেও পিছিয়ে নেই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালিত হয়। ঐ বছর সদ্য স্বাধীন দেশে পয়লা মে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। তারপর থেকে আজও পয়লা মে সরকারি ছুটির দিন বহাল আছে। এদিন শ্রমিকরা মহা উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালন করে মে দিবস। তারা তাদের পূর্বসূরীদের স্মরণে আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। শ্রমিক সংগঠনগুলো মে দিবসে আয়োজন করে নানা ধরণের সাংস্কৃতিক ও কল্যাণমুখী কর্মসূচীর। শ্রমিকরা এদিন তাদের নিয়মিত কাজ থেকে সাময়িক অব্যহতি পেয়ে থাকে। আনন্দঘন পরিবেশে তারা উদযাপন করে মহান মে দিবস। রাষ্ট্রের সরকারি দল ও বিরোধী দলসহ অন্যান্য বিভিন্ন সংগঠনও দিনটি পালন করে থাকে। এদিন দেশের সকল প্রচারমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় শ্রমিকদের পক্ষে সভা-সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়।
প্রতিবছর মে দিবস উদযাপনের মধ্যদিয়ে শ্রমিকরা একদিকে যেমন তাদের অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত ইতিহাসকে স্মরণ করে তেমনি স্বপ্ন দেখে তাদের অধিকারের ষোলআনা প্রাপ্তির। বাংলাদেশের শ্রমিকরাও নিঃসন্দেহে এর বাহিরে নয়। কিন্তু আজও বাংলাদেশের শ্রমিকদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের শ্রমিকদের দিকে তাকালে আমরা আজও দেখতে পাই মালিক শ্রেণী কিভাবে তাদেরকে শোষণ করছে। মালিক শ্রেণীর শোষণের ফলে অসহায়ের মতো শ্রমিকদেরকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। এইতো মাত্র ৮ বছর পূর্বে ২০১৩ সনের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সাভারে রানা প্লাজায় শ্রমিকদের উপর স্মরণকালের ভয়াবহ ভবন ধসে প্রায় বার শতাধিক নিরীহ শ্রমিকের করুণ মৃত্যু পুরো জাতিকে শোকাহত করে। ঘটনার আট বছর পুর্ণ হলেও রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে নিখোঁজ ১০৫ জন শ্রমিকের সন্ধান আজও মিলেনি, এমনকি অনেকের কপালে ক্ষতিপূরণের অর্থও জোটেনি। এর পূর্বে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লেগে ১১১ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যায়। এর আগে ২০১০ সালে হামিম গামেন্টসসহ তিনটি গার্মেন্টসে অনেক শ্রমিকের প্রাণ চলে যায়। এসবের অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে শুধুমাত্র মালিক শ্রেণীর গাফলতির কারণে। এভাবে প্রায় প্রতি বছর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোয় বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এসব দুর্ঘটনায় অনেক নারী-পুরুষ-শিশু মারা যায়। দুর্ঘটনায় যেসব শ্রমিক মারা যায়, তাদের পরিবারের রুটি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারা চোখেমুখে অন্ধকার দেখে। আর মালিক শ্রেণীরা এ থেকে রেহায় পেয়ে যাচ্ছে।
আজকের এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য বেতন পাচ্ছে না। যেখানে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল ৮ ঘন্টা কর্ম দিবসের জন্য। যেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোতে এখনও ৮ ঘন্টার পরিবর্তে ১২ ঘন্টা কাজ করানো হচ্ছে। বিনিময়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে নাম মাত্র। যা দিয়ে একজন মানুষ চলাফেরা করা কষ্টকর। আজকে শ্রমিকদের কোন নিরাপত্তা নেই। মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তারা পেটের দায়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চায়। এ নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় দ্বন্ধ দেখা যায়। আমাদের দেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। এসব নারী ও শিশু বিভিন্ন কল-কারখানা, বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে বেশি কাজ করে থাকে। অথচ আমাদের সংবিধানে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। তথাপি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকেই আবার জীবন ঝুঁকির মধ্যেও পড়ে যাচ্ছে। মারাও যাচ্ছে অনেক শ্রমিক। বাংলাদেশের শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার কারণে তারা শারীরিক-মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা হচ্ছে বঞ্চিত। এসব শিশু স্নেহ-ভালোবাসার অভাবে এক সময় অপরাধ জগতে পা বাড়ায়।
আসলে আমরা শ্রম বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝেও বুঝতে চাই না। একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। আর এটাই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা। একুশ শতকে এসে শ্রমিকরা এর কতটুকু মর্যাদা বা অধিকার ভোগ করছে? বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শ্রমিকরা এ দেশের সম্পদ। তাদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। তাদের অবহেলার চোখে দেখার কোন সুযোগ নেই। তাদের কাজের ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মহান মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমরা শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকারের কথা বলি কিন্তু বাস্তবে শ্রমজীবি মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শাসক, প্রশাসক ও মালিক গোষ্ঠি আদৌ আন্তরিক হতে পারিনি। যদিও সময়ের ব্যবধানে শ্রমজীবী মানুষের যান্ত্রিক বিপ্লবের কারণে কাজের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পরিবর্তন আসেনি শ্রমজীবি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার অদ্যবধি পর্যন্ত অধরাই থেকে গেল।
পোষাক শিল্পের বিকাশে এই দেশে নারীর শ্রমিকের অবদান অনেক বেশি। কিন্তু যেই নারী শ্রমিকের অবদানে দেশের জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, সেই নারী শ্রমিকের চলমান জীবনযাপন বড়ই দুর্বিষহ। বেতনের সাথে যাদের জীবনযাত্রার ব্যয় খাপ খায় না তারাই হলেন গার্মেন্টস শ্রমিক।
বাংলাদেশে কাজের ক্ষেত্রে পোষাক শ্রমিকের পর নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যাদের রক্ত ও ঘাম মিশে আছে তারাও তাদের শ্রমের ন্যায্য পাওনা অনেক সময় পায়না। শ্রম দিয়ে যারা শ্রমের মূল্য পায় না তারাই জানে জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার লড়াই কত কষ্টের? শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আল এল ও) এবং দেশের শ্রম আইনে সংবিধান অনুসারে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষিত আছে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার যেন কিতাবে আছে গোয়ালে নেই! বরাবরই এই দেশের দিনমজুর শ্রেণীর মেহনতি মানুষ বঞ্চিত ও শোষিত। বাংলাদেশের গৃহ কর্মীরাও কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। গৃহকর্মীর গায় গরম ইস্ত্রির সেকা দিয়ে পিট ঝলসিয়ে দেওয়া এবং নানাবিধ নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। শুধু তাই নয় গৃহ কর্মীদের উপর বর্বর নির্যাতনের পাশাপাশি খুন ধর্ষনও করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অধিকাংশ কৃষি কাজ ও কৃষি পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে জীবন-জীবিকা পরিচালনা করলেও কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী, কালোবাজারী ও সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে অহরহ বঞ্চিত হচ্ছে। এমনিভাবে পরিবহন সেক্টরে কর্মরত প্রায় ৫০ লক্ষাধিক শ্রমিক প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনসাধারণের সেবা প্রদান করলেও তাদের মজুরী নির্ধারনে সরকারের পক্ষ থেকে কোন নীতিমালা আজও প্রণয়ন করা হয়নি। লাখ লাখ রিকশা শ্রমিক প্রতিনিয়ত তাদের জীবন পরিচালনায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। এ শ্রেণীর শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নে রেশনিং, চিকিৎসা সেবা ও সন্তানদের শিক্ষা অধিকার আজও নিশ্চিত হয়নি। মোদ্দা কথা মে দিবসে যেভাবে আমরা শ্রমিক অধিকার নিয়ে কথা বলি তার তুলনায় বাস্তবে শ্রমিকের অধিকার ও অর্জন অনেক সীমিত।
মে দিবসের মূল্যায়নঃ
শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা তাদের কিছু অধিকার অর্জন করলেও সকল দিক থেকে শ্রমিকরা তাদের অধিকার পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। মে দিবস ঘটা করে পালন হলেও শ্রমিকরা আজও অবহেলা ও অবজ্ঞার স্বীকার। আজও তারা তাদের কাঙ্খিত মজুরি নিশ্চিত করতে পারেনি। কর্মক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টা শ্রমের নিয়ম হয়তো বা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, কিন্তু থামেনি শ্রমিক নিপীড়ন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়নি শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা ও শ্রমের মূল্য। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অহরহ শ্রমিক বিক্ষোভ থেকে আমরা সহজেই এটা অনুধাবন করতে পারি। বেতন বৃদ্ধি কিংবা বকেয়া বেতন আদায়ের নিমিত্তে প্রতিনিয়তঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ গার্মেন্টে নৈরাজ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। গার্মেণ্টস শ্রমিকরা দাবী আদায়ে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ করে যাচ্ছে। মালিক পক্ষ হর-হামেশাই শ্রমিকদেরকে ঠকিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন ঠেকানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে শ্রমিক নেতা-নেত্রীদেরকে গ্রেফতার করানো হচ্ছে। গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আমিনুলকে দীর্ঘদিন গুম করে রেখে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই এটি দৃঢ়তার সাথে বলা যায় আজও দুনিয়ার কোথাও শ্রমিক-মালিক সু-সম্পর্ক, শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি এবং তাদের বাঁচার উন্নত পরিবেশ কাঙ্খিত মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করে। আইএলও শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ পর্যন্ত ১৮৩টি কনভেনশন প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ৮টি কোর কনভেনশনসহ ৩৩টি কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। তাছাড়া দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী সরকার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে দায়বদ্ধ। কিন্তু আমাদের শ্রমিকরা কতটুকু অধিকার পাচ্ছে, শ্রমিকদের কতটুকু কল্যাণ সাধিত হয়েছে আজ এই সময়ে তা কঠিন এক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ লেবার ফোর্সের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ মহিলা শ্রমিক। মে দিবস যায়, মে দিবস আসে। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্য যেন আর খোলে না।
শ্রমজীবি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী শ্রমনীতির অনিবার্যতাঃ
আধুনিক বিশ্বের পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী রাষ্ট্র দর্শনের কোনটাই শ্রমিকের প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদার ন্যূনতম সমাধান দিতে পারেনি। তারা মুখে শ্রমিক অধিকারের কথা বললেও বাস্তবে শ্রমিকদেরকে পুঁজি করে রাজনীতি করাসহ অগাধ অর্থ বৈভবের মালিক হয়েছে। ফলে এখনও শ্রমিক-মজুররা নিষ্পেষিত হচ্ছে। মালিকের অসদাচরণ, কম শ্রমমূল্য প্রদান, অনপযুক্ত কর্ম পরিবেশ প্রদানসহ নানা বৈষম্য শ্রমিকের দুর্দশা ও মানবেতর জীবনযাপনের কারণ হয়ে আছে। যে অধিকারের জন্য শ্রমিকরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন শিকাগোর রাজপথে, তা বাস্তবে এখনও অর্জিত হয়নি। আজও শ্রমিকেরা পায়নি তাদের কাজের উন্নত পরিবেশ, পায়নি ভালোভাবে বেঁচে থাকার মতো মজুরি কাঠামো এবং স্বাভাবিক ও কাঙ্খিত জীবনের নিশ্চয়তা। মূলতঃ ইসলামী শ্রমনীতি চালু এবং সৎ ও ন্যায়বান লোকদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা আসলে তারাই শ্রমিকের অধিকার আদায় ও রক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারবে। তাছাড়া কোনভাবেই শ্রমিক সমাজের প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদা আদায় সম্ভব হবেনা। ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠা হলে ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে দেশের শ্রমনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে শ্রমজীবি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মানুষের মত বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরী নির্ধারন করা হবে। একজন মালিকের নিজের স্বজনরা যে রকম জীবনযাপন করবে তার অধিনস্থ শ্রমিকরাও সে রকম জীবনের নিশ্চয়তা পাবে। কাজেই শ্রমিক সমাজসহ দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীকে ইসলামী শ্রমনীতি চালু ও বাস্তবায়নের নিমিত্তে সৎ ও ন্যায়বান লোকদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা আনয়নে প্রচেষ্টা চালানো জরুরী।
মে দিবসের প্রত্যয় ও করনীয়ঃ
মহান মে দিবস কে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রকৃত অর্থে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে শ্রমজীবি মানুষসহ সকল দায়িত্ববান নাগরিকদেরকে শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নে নি¤েœাক্ত দাবীসমূহ বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দাবী আদায়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
১. ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে দেশের শ্রমনীতিকে ঢেলে সাজানো।
২. শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে মুনাফায় শ্রমিকদের অংশ প্রদান করা।
৩. সকল বন্ধ কল-কারখানা চালু করা।
৪. শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন মজুরী অবিলম্বে পরিশোধ করা।
৫. জাতীয় নুণ্যতম মজুরী কাঠামো নির্ধারণ ও অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা।
৬. গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার উপযোগী মজুরী নির্ধারন করা।
৭. শ্রমিকদের ন্যায় বিচার ত্বরান্বিত করার স্বার্থে শ্রমঘণ এলাকায় শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা করা।
৮. শ্রমজীবি মানুষের জন্য বাসস্থান, রেশনিং, চিকিৎসা ও তাদের সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা।
৯. কল-কারখানায় ঝুঁকিমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
১০. আহত ও নিহত শ্রমিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা।
১১. শ্রমিকদের পেশাগত ও নৈতিক ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা।
১২. নারী ও পুরুষের বেতন-ভাতার সমতা বিধান করা।
১৩. কল-কারখানায় নারী শ্রমিকদের জন্য প্রসূতিকালীন ছুটি ও ভাতা প্রদান নিশ্চিত করা।
১৪. নারী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য শিশু যতœাগার স্থাপন করা।
১৫. শিশু শ্রম বন্ধ করা।
১৬. সকল পেশায় অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং সকল পেশার শ্রমিকদের শ্রম আইনের সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করা।
১৭. শ্রমিকের প্রতি মালিকের সহনশীল মনোভাব পোষনে কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া।
১৮. শ্রমিকদের মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আলোকে কাজ দেওয়া।
১৯. সঠিক সময়ে শ্রমিকের মজুরী পরিশোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
২০. ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়নের আন্দোলনে শ্রমজীবি মানুষসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা।
পরিশেষে বলবো যে, আসুন আমরা সবাই মিলে শ্রমজীবি মানুষের সত্যিকার মুক্তি অর্জনে যার যার অবস্থান থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করি। নির্যাতিত-নিপীড়িত ও অধিকার বঞ্চিত শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করি এবং শ্রমজীবি মানুষের পরকালীন মুক্তি অর্জনে তাদেরকে ইসলামী আদর্শের পতাকাতলে শামিল করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করি। ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগীতার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করি। মহান আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমিন