৮. উন্নত আমলের অধিকারী
আদর্শিক সংগঠনের নেতৃত্বকে আবশ্যকীয়ভাবে সে আন্দোলনের আদর্শকে ধারণ করতে হয়। প্রচলিত আন্দোলন ও আদর্শিক আন্দোলনের নেতৃত্বের মাঝে মৌলিক পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা থাকতে হয়। আদর্শিক শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বের আমল হবে উন্নত আকর্ষণীয়, তিনি সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকার জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন। আল্লাহর নির্দেশিত ইবাদত সমূহ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন, লোভহীন ও সহজ সরল জীবন-যাপন, লেনদেনে পরিচ্ছন্নতা, নেফাকি মুক্ত জীবনের অধিকারী এবং আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে শ্রমিক নেতৃত্বের অন্যতম আদর্শিক বৈশিষ্ট্য।
৯. উচ্চ ও পবিত্র চরিত্রের অধিকারী
একজন শ্রমিক নেতার ব্যক্তিগত জীবন আমলে সালেহের সৌন্দর্যে সুশোভিত হতে হবে। ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ইসলামকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। তার চরিত্রে এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে কোনো ব্যক্তি তাতে একটি দাগও খুঁজে না পায়। তার আশেপাশের পরিবেশ, সমাজ, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, আপনজন ও আত্মীয় স্বজন যেনো এ কথা মনে করে যে, আমাদের মধ্যে এক উচ্চ ও পবিত্র চরিত্রের ব্যক্তি রয়েছেন।
রাসুল (সা.) যখন আল্লাহর দ্বীনের পথে মানুষকে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেছেন তখন সেই সমাজ যাদের মধ্যে তিনি জীবনের চল্লিশটি বছর অতিবাহিত করেছেন তাদের মধ্যে এমন একজন লোকও ছিলো না, যে তার উন্নত চরিত্রের প্রশংসাকারী ছিলো না। যে ব্যক্তি তাঁর যতো নিকটে অবস্থান করেছিলো, সে ততো বেশি তার প্রতি অনুরক্ত ছিলো। যে লোকগুলোর নিকট তাঁর জীবনের একটি দিকও গোপন ছিলো না, তারাই সর্বপ্রথম তাঁর নবুয়তের স্বীকৃতি প্রদান করেন।
হযরত মালেক বিন হুযাইরিম (রা.) বলেছেন, আমরা কতিপয় তরুণ যুবক নবি করিম (সা.) এর দরবারে থাকার জন্য পৌঁছলাম। আমরা বিশ রাত পর্যন্ত তাঁর দরবারে রইলাম। সত্যিই আল্লাহর রাসুল (সা.) অত্যন্ত নরম, হৃদয়বান ও দয়ালু ছিলেন।
রাসুল (সা.) এর ব্যাপারে হযরত আনাস (রা.) এর উক্তি, আমি একটানা ১০ বছর হুজুরে পাক (সা.) এর খেদমতে কাটিয়েছি, এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হুজুর (সা.) কখনও আমার প্রতি বিরক্ত প্রকাশ করেননি। কখনও এমন কথা বলেন নি যে, অমুক কাজটা কেন করলে কিংবা অমুক কাজটা কেন করলে না? (সহিহ বুখারি)
১০. আদর্শিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ
নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জ্ঞান অর্জন। নেতা হবেন বিজ্ঞ শিক্ষক তথা ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী। যে আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে আন্দোলন সম্পর্কে তার বিশেষ জ্ঞান থাকতে হবে। এছাড়া আদর্শ, আন্দোলন ও সংগঠন সংক্রান্ত যেই কোনো প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেওয়ার মতো জ্ঞান নেতৃত্বের মাঝে থাকতে হবে। নেতাকে কুরআন-হাদিস, ইসলামি সাহিত্য ও সম-সাময়িক পরিস্থিতি উপর পরিকল্পিত জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং সে আলোকে জনশক্তিকে পরিচালনা ও জনশক্তির মন মগজ পরিষ্কার রাখা একজন নেতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১১. কথা ও কাজের মিল
একজন নেতার কথা ও কাজের মাঝে অবশ্যই মিল থাকতে হবে। তিনি অধস্তনকে যা বলবেন তা নিজে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট থাকবেন। আর করার নিয়ত কিংবা সৎ সাহস না থাকলে তা মুখেও আনবে না। এক রকম কথা বলা অন্যরকম কাজ করা মানুষের এমন একটি জঘন্য দোষ যা আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে অত্যন্ত ঘৃণিত। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করার দাবি করে তার পক্ষে এমন নৈতিক দোষ ও বদস্বভাবে লিপ্ত হওয়া আদৌ সম্ভব নয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো যা নিজেরা করো না? আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে তোমরা এমন কথা বলো যা করো না।” (সুরা আস-সফ: ২-৩)
১২. ইখলাস বা নিয়তের বিশুদ্ধতা
নেতৃত্বের অন্যতম আদর্শিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইখলাস বা নিয়তের বিশুদ্ধতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বান্দাদেরকে একনিষ্ঠভাবে ইখলাসের সহিত তার ইবাদত তথা দাসত্ব করার নির্দেশ দিয়েছেন। আন্দোলনের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব তা যে প্ল্যাটফরমেই হোক না কেনো ইখলাসের সাথে পালনের মাঝেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হবে। ইখলাস বিহীন নেক আমল আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নয়। আল্লাহ বলেন, “তাদেরকে তো এছাড়া আর কোনো হুকুম দেওয়া হয়নি যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে তার ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে ও যাকাত দেবে, এটাই যথার্থ সত্য ও সঠিক দ্বীন।” (সুরা আল বাইয়্যেনাহ: ৫)
১৩. মানবতার কল্যাণকামী
শ্রমিক নেতৃত্বের অন্যতম আদর্শিক বৈশিষ্ট্য হলো তিনি শ্রমিক জনগোষ্ঠীসহ সাধারণ জনগণের কল্যাণে ভূমিকা পালন করবেন, তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে কাজ করে যাবেন, তাদের দ্বীন শিখানোর উদ্যোগ নিবেন। নেতৃত্বের কল্যাণকামিতায় বিষয়ে আল্লাহর বাণী, “আর সালেহ এ কথা বলতে বলতে তাদের জনপদ থেকে বের হয়ে গেলো, “হে আমার সম্প্রদায়। আমার রবের বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং আমি তোমাদের জন্য যথেষ্ট কল্যাণ কামনা করেছি। কিন্তু আমি কি করবো, তোমরা তো নিজেদের হিতাকাঙ্খীকে পছন্দই করো না।” (সুরা আল আরাফ: ৭৯)
১৪. পরামর্শভিত্তিক কিংবা অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ:
দায়িত্বপালনে প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করা নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি মুমিনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্যও বটে। নেতৃত্ব প্রদান করতে হলে নেতাকে পরস্পরের মাঝে পরামর্শের মনোবৃত্তি অর্জন করতে হবে। কেননা, পরামর্শের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তে সকলের ঐক্যমত থাকে, ভুল হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে, ভুল হলেও নেতৃত্বকে দায়ী করা হয় না। ফলে সেটি বাস্তবায়নে সুবিধা হয়। রাসুল (সা.) পরামর্শ শুনতে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। পরামর্শ দেওয়া-নেওয়া আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ বলেন, “আর আপনি তাদের সাথে পরামর্শ করুন।” (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)। “যারা তাদের রবের নির্দেশ মেনে চলে, নামাজ কায়েম করে এবং নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পাদন করে, আমি তাদের যা রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।” (সুরা আশ শুরা:৩৮)
কাজেই মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে অধস্তনদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। মানুষের মুখ বন্ধ করে তাদের হাত পা বেঁধে তাদেরকে অন্ধকারে রেখে সামষ্টিক ব্যাপারসমূহ পরিচালনা করা বড়ো রকমের জুলুম।
১৫. ত্যাগের মহীমায় উজ্জীবিত
আদর্শিক নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি হলো ত্যাগী মনোভাব। একজন যথার্থ নেতা হচ্ছেন তিনি যিনি আন্দোলনের কল্যাণের জন্য নিজের যে কোনো ক্ষতি স্বীকার করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। নিজের ধন, মাল, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, আরাম আয়েশ, পেশাগত দিক সবকিছুর উপর তিনি প্রাধান্য দেন আন্দোলন সংগঠনের স্বার্থ ও প্রয়োজনকে। আন্দোলনের স্বার্থে প্রয়োজনে তিনি সবকিছু বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকবেন। মনে রাখতে হবে যিনি নিজের কথা আগে চিন্তা করেন তারপর সংগঠনের চিন্তা করেন তার পক্ষে সত্যিকার নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেকে এমন আছেন জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেওয়ার কথা বলে বেড়ান কিন্তু বাস্তবে ছোট-খাট ত্যাগ স্বীকার করতেও পিছপা হন। আন্দোলন সংগঠনের জন্য নিজের সামান্য ব্যক্তিগত সুবিধা ও স্বার্থ পরিহার করতে চান না, তারাই মোটেই প্রকৃত নেতা নন।
কাজেই নেতৃত্বকেই সর্বাগ্রে ত্যাগ ও কুরবানির উদাহরণ পেশ করতে হবে। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.)-ই আমাদের নিকট শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন অল্পেতুষ্ঠ মানুষ। মদিনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান হয়েও তিনি অত্যন্ত সাদাসিদে জীবন-যাপন করতেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) এর হাতে অনেক টাকা পয়সা আসতো। তিনি সেসব নিজে ভোগ না করে অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন।
আবু সিরওয়াআহ উক্ববাহ ইবনে হারেস (রা.) বলেন যে, আমি নবি (সা.) এর পিছনে মদিনায় আসরের নামাজ পড়লাম। অতঃপর সালাম ফিরে তিনি অতি শীঘ্র দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর লোকদের গর্দান টপকে তাঁর কোনো এক স্ত্রীর কামড়ায় চলে গেলেন। লোকেরা তাঁর ক্ষীপ্রতা দেখে ঘাবড়ে গেল। অতঃপর তিনি বের হয়ে এলেন; দেখলেন লোকেরা তাঁর ক্ষীপ্রতার কারণে আশ্চর্যান্বিত হয়েছে। তিনি বললেন, “(নামাজে) আমার মনে পড়ল যে, (বাড়িতে সোনা অথবা চাঁদের) একটি টুকরা রয়ে গেছে। আমি চাইলাম না যে, তা আমাকে আল্লাহর স্মরণে বাধা দেবে। যার জন্য আমি (দ্রুত বাড়িতে গিয়ে) তা বণ্টন করার আদেশ দিলাম। অন্য এক বর্ণনায় আছে, “আমি বাড়িতে সাদকার একটি সম্পদ ছেড়ে এসেছিলাম। অতঃপর আমি তা রাতে নিজ গৃহে রাখা পছন্দ করলাম না।” (সহিহ বুখারি: ৮৫১)
উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা.) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাপড় কখনো পার্ট করে রাখা হতো না। অর্থাৎ তাঁর অতিরিক্ত কাপড় ছিলো না যা পাট করে রাখা যেতো।” রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ইন্তেকালের পর আয়িশা (রা.) বলেন যে, “রাসুলুল্লাহ (সা.) এই দুনিয়া থেকে চলে গেছেন কিন্তু কখনও দু’বেলা পেট ভরে খেতে পারেননি।”
১৬. ধৈর্যশীল
একজন নেতাকে অবশ্যই বিপদে আপদে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। ধৈর্যশীলতার চেয়ে অন্য কোনো সৎগুণ নেতৃত্বের সাথে এতটা সম্পর্কযুক্ত নয়। আদর্শিক সংগঠনের চলার পথ ফুল বিছানো নয়। এই পথ অত্যন্ত বন্ধুর ও কণ্টকাকীর্ণ। নেতাকে বিশ্বাস করতে হবে আল্লাহর অনুমোদন ছাড়া কোনো বিপদ আসে না। বিপদে আপদে দুঃখ-কষ্টে যারা ধৈর্য ধরবে তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।
আল্লাহ বলেন, “আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানি হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে এবং যখনই কোনো বিপদ আসে বলে আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে। তাদেরকে সুসংবাদ দাও।” (সুরা বাকারা; ১৫৫-১৫৬)
১৭. ক্ষমা করার মানসিকতা অর্জন
নেতৃত্বের জন্য ক্ষমা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যোগ্য নেতৃত্ব দিতে হলে নেতৃত্বের মাঝে অধস্তনদের ভুল-ত্রুটি অবশ্যই ক্ষমা করার মানসিকতা থাকতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসুল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, “তাদের ত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করো” (সুরা আল ইমরান: ১৫৯)। অন্যত্র বলা হয়েছে, “হে নবি! কোমলতা ও ক্ষমার পথ অবলম্বন করো। সৎকাজের উপদেশ দিতে থাকো।” (সুরা আল আরাফ: ১৯৯)
১৮. ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভূমিকা পালনকারী
নেতৃত্বের আদর্শিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হচ্ছে তিনি ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী হবেন। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত না হলে কোনো আদর্শিক আন্দোলন বা সংগঠনের সফল হওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনীর পরস্পর দৃঢ় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হলে সংগঠনের কাজের অগ্রগতি অনেক বেড়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নেতাকে সর্বাগ্রে ভূমিকা রাখতে হবে।
ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির জন্য নেতৃত্বের অন্তরের মধ্যে উষ্ণতা ও উদারতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে ভ্রাতৃত্ব মুখের নয় বরং অন্তরের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। রাসুল (সা.) এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর মদিনার আনসার ভাইয়েরা মুহাজির ভাইদের প্রতি এতই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন যে, নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মুহাজির ভাইয়ের সাথে বিবাহ দিয়ে দেন। বসবাসের জন্য বাড়ির একাংশ বা একতলা ছেড়ে দেন। আবাদি জমি বা বাগান মুহাজির ভাইকে চাষাবাদের জন্য ছেড়ে দিয়ে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে দেন।
ইখওয়ানুল মুসলিমিনের ইতিহাস পড়ে জানা যায়, একবার ইখওয়ানের সদস্যরা জানতে পারল, তাদের এক ভাইয়ের আয় উপার্জন নেই। চাকরি হারিয়ে বাড়িতে বেকার বসে আছেন। তখন একে একে দশ জনের অধিক সাথি তাঁর কাছে যান। প্রত্যেকে গিয়ে একান্তে তার সাথে কথা বললেন। নিজেদের সঞ্চিত অর্থের একটা অংশ তাঁর কাছে পেশ করলেন, যাতে কিছু পুঁজি হাতে এলে তাদের এই বেকার ভাইটা কিছু করতে পারেন। তখন তিনি কয়েকজনের প্রস্তাব মেনে নিয়ে অন্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন- আমার যথেষ্ট হয়েছে, আর লাগবে না। তখন অন্যরা দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে যান। কারণ তারা সাহায্য করার সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, “আল্লাহ সেই সব লোকদের ভালবাসেন যারা তাঁর পথে এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে যেন তারা সীসা গলিয়ে ঢালাই করা এক মজবুত দেয়াল।” (সুরা আস সফ: ৪)
১৯. প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা রক্ষাকারী
নেতৃত্বের আদর্শিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক হল প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা রক্ষা করা। প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করা একজন মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ গুণ। প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা মুনাফিকের লক্ষণ। নেতৃত্বের কমিটমেন্টের গুরুত্ব থাকতে হবে। অধস্তনদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন না করলে নেতৃত্বকে নেতিবাচক আচরণের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, “মুনাফিকের আলামত ৩টি। ১. যখন কথা বলে তখন মিথ্যা বলে, ২. প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করে ও ৩. আমানত রাখলে খেয়ানত করে।”
২০. সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা পোষণ
নেতৃত্বকে বৈষয়িক উপায়-উপকরণ ও পার্থিব সাহায্য-সহযোগিতার চেয়ে আল্লাহর সাহায্যের উপর বেশি নির্ভর করতে হবে। দায়িত্বপালনকালে বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে ঘাবড়ানো ঠিক নয়। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের ভিত্তিতে এমন আত্মবিশ্বাস জন্মাতে হবে যে, আল্লাহর সাহায্য আমি পাবই। কেননা এ দায়িত্ব আমি কামনাও করিনি, চেয়েও নিইনি। আল্লাহ বলেন, “আর যখন কোনো সংকল্প করেন তখন আল্লাহর উপর ভরসা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালোবাসেন” (সুরা আল ইমরান:১০৯)। অন্যত্র বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে, আল্লাহ তাঁর জন্য যথেষ্ট।” সুরা আত তালাক:৩
২১. নফল ইবাদতের প্রতি যথাসম্ভব গুরুত্ব আরোপ
আদর্শিক আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনে আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত সম্ভব হয় না। আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্বকে আল্লাহর সাথে যথাযথ সম্পর্ক স্থাপনকে গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে তাহাজ্জুদের নামাজ এবং নফল রোজা রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক নবির জন্য আল্লাহ একটা করে খায়েশ পয়দা করেছেন, আমার খায়েশ রাতের নামাজ।”
হযরত মুগীরা ইবনে শোবা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) (তাহাজ্জুদ নামাজে) এতে বেশি সময় ধরে দাঁড়ালেন যে, তাঁর দু’পায়ের পাতা ফুলে গেলো। তখন বলা হলো হুজুর, আপনি কেনো এরূপ করেন? অথচ আল্লাহ তো আপনার আগের ও পেছনের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। রাসুল (সা.) জবাব দিলেন, আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দাহ হবো না?” (বুখারি ও মুসলিম)
২২. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই হবে মূল লক্ষ্য:
একজন নেতৃত্বের কর্মতৎপরতা আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছুকে লক্ষ্য রেখে করা পশ্রম মাত্র। একজন আদর্শ নেতার ইবাদত-বন্দেগী, আন্দোলন, সংগঠন, ত্যাগ-কুরবানি, জীবন-মৃত্যু সবকিছু আল্লাহর জন্য হতে হবে। আল্লাহ বলেন, “বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য।” (সুরা আল আনআম: ১৬২)
নেতৃত্বের বর্জনীয় দিক
১.অহংকার ও আত্মম্ভরিতা
নেতৃত্বের অবস্থান জবাবদিহির ও সুচারু রূপে কার্য সম্পাদন। নেতৃত্বকে অহংকারে পরিণত করা কিংবা ক্ষমতা মনে করা কাম্য নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অহংকারীকে পছন্দ করেন না। অহংকারীর স্থান হবে জাহান্নামে। আল্লাহ বলেন, “পৃথিবীর বুকে চলো না উদ্ধত ভঙ্গিতে। আল্লাহ পছন্দ করেন না আত্মম্ভরিতা ও অহংকারীকে” (সুরা লোকমান: ৩)। অন্যত্র বলা হয়েছে, “এখন যাও, জাহান্নামের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ো, ওখানেই তোমাদের থাকতে হবে চিরকাল। সত্য বলতে কী, অহংকারীদের এই ঠিকানা বড়োই নিকৃষ্ট।” (সুরা আন নাহল: ২৯)
২.হিংসাত্মক মনোভাব
কারও উন্নতি বা ভালো অবস্থা দেখে তা অসহ্য হওয়া এবং মনে মনে তার ভালো অবস্থা না থাকা কামনা করা। হিংসাত্মক মানসিকতার কারণে কাউকে যোগ্যতার আলোকে পদায়ন না করা। রাসুল (সা.) এ মর্মে সতর্কবানী উচ্চারণ করে বলেছেন, তোমরা হিংসা থেকে বিরত থাকো। কেননা, হিংসা মানুষের সৎকর্মগুলোকে খেয়ে ফেলে যেমনিভাবে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে। (আবু দাউদ: ৪৯০৫)
৩.প্রদর্শনেচ্ছার মানসিকতা
নেতৃত্বের সকল কর্মতৎপরতার মূল লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও পরকালীন কল্যাণ। লোক দেখানো বা প্রদর্শনেচ্ছা মনোভাব আদর্শিক নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
৪.কথা ও কাজের মিল না থাকা
নেতৃত্বের কথা ও কাজে অবশ্যই মিল থাকতে হবে। কেননা কথা ও কাজের মিল না থাকা মুনাফিকির অন্যতম লক্ষ্যণ। আদর্শিক নেতৃত্বের মাঝে মুনাফিকি থাকতে পারে না।
৫.পরনিন্দা ও পরচর্চার অভ্যস্ততা
মানুষের গুনাহ উল্লেখযোগ্য হয় জবান বা বাকশক্তি দ্বারা। কোনো ব্যক্তি সম্বন্ধে তাঁর অগোচরে তাঁর পোশাক-পরিচ্ছেদ, কর্ম, চলাফেরা, চরিত্র ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ের কোনো দোষ অপরের কাছে প্রকাশ করাই গীবত বা পরনিন্দা। আদর্শিক আন্দোলনের নেতৃত্বকে এ ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কটু কথা, অশ্লীল কথা বার্তা বলা থেকে বিরত থাকার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আল্লাহর বাণী, “আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া পছন্দ করবে?” (সুরা হুজরাত: ১২)
৬.ভুল স্বীকার করার মানসিকতা না থাকা
নিজের দোষ স্বীকার করার মতো উদারতা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। নেতাও একজন রক্তে-মাংসের মানুষ, তাই তিনি ভুলের ঊর্ধ্বে নন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও নেতার ভুল হতে পারে। সেই ভুল স্বীকারের মানসিকতা থাকতে হবে।
৭.ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা
নেতৃত্বের আত্মসম্মানবোধ নেতৃত্ব প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ দিক। ব্যক্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে এমন কোনো কথা বা কাজ করা যাবে না। স্থান কাল, পাত্রভেদে কথা না বলা, শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে সতর্ক না থাকা কিংবা জনশক্তির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করার ফলে নেতৃত্বের ব্যক্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
৮.অত্যাধিক রাগ বা ক্রোধ
রাগ মানুষকে সীমালঙ্ঘনের দিকে নিয়ে যায়। রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত ঠিক হয় না। রাগ প্রয়োজন মত থাকা দরকার, বেশি হলে বিপদ। নেতৃত্বের জন্য সুস্থ মস্তিষ্ক জরুরি। আল্লাহর বাণী, “যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো প্ররোচনা আঁচ করতে পারো, তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো, তিনি সব কিছু শোনেন এবং জানেন।” (সুরা হা-মীম সাজদাহ: ৩৬)
৯.প্রশ্নবিদ্ধ আমানতাদারিতা ও মোয়ামেলাত
আমানতদারিতা ও মোয়ামেলাত প্রশ্নবিদ্ধ হলে নেতৃত্ব নানামুখী বিতর্কের সম্মুখীন হন। আমানতের খেয়ানত করা ও ব্যবহারিক জীবন স্বচ্ছ না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে নেতৃত্ব প্রদান কঠিন হয়ে পড়ে।
১০.জনশক্তি পরিচালনায় কঠোরতা
কঠোর মানসিকতা নেতৃত্বের জন্য কল্যাণকর নয়। নেতৃত্বকে কোমল ব্যবহার, মধুর ভাষা, মেজাজের ভারসাম্য রক্ষা করে সংগঠন পরিচালনা করতে হয়। নেতৃত্ব প্রদানে অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা পরিহার করা প্রয়োজন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) বলেছেন, “নেতৃত্বের জন্য চারটি গুণ অপরিহার্য। ১. কোমলতা, তবে দুর্বলতা নয়, ২. দৃঢ়তা, তবে কঠোরতা নয়, ৩. স্বল্প ব্যয়িতা, তবে কৃপনতা নয়, ৪. দানশীলতা, তবে অপব্যয় নয়।” আল্লাহ বলেন, “মুমিনদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের সাথে বিনম্র ব্যবহার করো।” (সুরা শুআরা: ২১৫)
নেতৃত্বদানে সফলতার কতিপয় দিক
১.সাহসিকতা।
২.উদার ও স্থির চিত্ততা।
৩.সমালোচনা হজমের যোগ্যতা।
৪.কাজ পর্যালোচনা কিংবা ফলোআপ করার দক্ষতা।
৫.সবার সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা।
৬.জনশক্তির অনুপ্রেরণায় উৎস হওয়া।
৭.নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলা।
৮.সমসাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ থাকা।
৯.আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে সতর্ক এবং সৎ থাকা।
১০.সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হওয়া তথা সময় সচেতনতা, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করার প্রবণতা, কাজকে অগ্রাধিকারের আলোকে বিন্যাস করা এবং সকল কিছুর ভারসাম্যতা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকা।
১১.কোনো কাজ শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকা। কোনো কাজকে অর্ধেক করে রেখে দেওয়া যাবে না।
১২.ব্যক্তিগত বলয় বৃদ্ধি করা। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সৌজন্যমূলক যোগাযোগ রাখা এবং সবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা।
১৩.অতিরিক্ত কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে তা সাদরে গ্রহণ করা। এতে Capacity (সক্ষমতা) বৃদ্ধি পায়।
১৪.কর্মজীবন, পারিবারিক জীবন ও সাংগঠনিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্যতা বজায় রাখা।
১৫.শরীরের প্রতি যত্মবান থাকা। খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম ও সময় অনুসরণ করা।
১৬.পরিবারকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া।
১৭.কোনো কাজে দ্রুত সফলতার প্রত্যাশা না করা। ধৈর্য ধরে কাজ করে যেতে হবে এবং সফলতা অর্জন হওয়া ব্যতীত হাল ছাড়া যাবে না।
১৮.দিনের কাজ দিনেই শেষ করা
১৯.অন্যের উপর অত্যাধিক নির্ভরশীল না থাকা।
২০.অর্পিত দায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে পালন করা এবং কাজকে ভালবাসতে শিখা।
২১.সুযোগ-সুবিধা নিজে কম নিয়ে অন্যকে বেশি দিতে অভ্যস্ত হওয়া।
২২.নেতার মর্যাদা এবং ভাল মানুষ হিসেবে অধীনস্তদের শ্রদ্ধা অর্জনের যোগ্যতা অর্জন করা।
২৩.যেটুকু যোগ্যতা আছে তা নিয়েই আত্মবিশ্বাসী হওয়া। আত্মবিশ্বাস মানুষকে সাফল্যের পথে নিয়ে যায়।
২৪.নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রেখে তা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। চূড়ান্ত লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত স্থির ও শান্ত থাকা।
২৫.আবেগতাড়িত হয়ে কোনো কাজ করা যাবে না। কোনো কাজে সফলতা পেতে হলে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
২৬.সময়ের মূল্য দিয়ে প্রতিটি ঘণ্টা, মিনিট কে Productively কাজে লাগাতে হবে। সময় নষ্ট করে এমন কাজের সাথে সম্পৃক্ত না থাকা।
লেখক: সম্পাদক, দ্বি মাসিক বার্তা